যুবলীগ সভাপতির পকেটে এতিমের দেড় কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩০ এএম, ৩১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৮ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
১০ লাখ টাকা পুঁজি খাঁটিয়ে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা পকেটে পুড়েছেন সাড়ে তিন ডজন মামলার আসামি ও পলাশের এক ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি। নরসিংদীর পাঁচদোনা-ডাঙ্গা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে এখন এমন রমরমা ব্যবসাই হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রস্তাবিত মহাসড়কের পাশের এসব জমিতে রাতারাতি অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে অথবা পুরোনো ভবন ক্রয় করে সরকারের প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোরও অভিযোগ উঠেছে। আর এসব অভিযোগ সরকার দলের প্রভাবশালী নেতা, জনপ্রতিনিধি এমনকী সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও।
এলাকাবাসীর অভিযোগের তীর সবচেয়ে বেশি যার দিকে তিনি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি ও সাড়ে তিন ডজন মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু। এলাকায় তিনি ডাকাত হিসেবেও পরিচিত। তার নেতৃত্বে শতাধিক সদস্যের বাহিনীও রয়েছে, যার নাম আবার ‘দেলু বাহিনী’। এই বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায় না এতিম, নারী ও শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় এমনকী দলের নেতাকর্মীরাও। সম্প্রতি তিনি এক এতিমখানার এক কোটি ৪২ লাখ টাকা জোড়পূর্বক আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এ ঘটনায় যারাই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন তাদের তিনি নানাভাবে ভয়ভীতি ও নাজেহাল করছেন।
এলাকাবাসী জানায়, এই দেলু বাহিনীর অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তার আর রক্ষা নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এমন কোনো লোক নেই এই বাহিনীর হাতে নাজেহাল হয়নি। শিল্পোন্নত এ এলাকার বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, জমি জবরদখল, শীতলক্ষ্যা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মহাসড়ক ও ইটের ভাটায় চাঁদাবাজি ছাড়াও এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করে না এই দেলু বাহিনী। এসব করে টাকার পাহাড় গড়েছেন বাহিনী প্রধান দেলু। শুধু ডাঙ্গায়ই নির্মাণ করেছেন ছয়টি বিলাসবহুল বহুতল ভবন। এ ছাড়াও ঢাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে রয়েছে তার অনেক টাকা। অথচ তিনি একজন মাটি কাটার শ্রমিক ছিলেন।
সম্প্রতি উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজিরচর গ্রামের আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া কাজিরচর দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসা ও এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুস সালামের পালিত মেয়ের স্বামী এই দেলু তার শ্বশুরকে জিম্মি করেন। তারপর বাবা সুরুজ আলির সহায়তায় সরকারি অধিগ্রহণের এক কোটি ৪২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায় পুরো জেলাব্যাপী নিন্দার ঝড় বইছে।
মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রধান শিক্ষকসহ একাধিক শিক্ষকের ভাষ্য, পাঁচদোনা-ডাঙ্গা চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের জন্য তিন বছর আগে মাদ্রাসার একমাত্র দ্বিতল ভবনটি অধিগ্রহণ করা হয়। এ খবর পেয়ে আয়নাল মিয়া নামে এক ব্যক্তি আসেন এই ভবন ক্রয় করতে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানালে দেলু ডাকাত ও তার বাবা সুরুজ আলি ভবন বিক্রি করতে তাদের চাপ দেয়। পরবর্তীতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে সভা ডাকে। ওই সভায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন তিনজন হলেন ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য কৌশিক আহমেদ নয়ন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও তরুণ ইটাভাটা ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম হৃদয় ও স্থানীয় ইউপি সদস্য সালাউদ্দিন মিয়া। তারা জানান, যেহেতু সরকার জমি ও ভবন অধিগ্রহণ করেছে সেহেতু এই ভবন এখন আর বিক্রি করার সুযোগ নেই।
পরে দেলুর লোকজন ভবনটি ৩০ লাখ টাকায় দেলোয়ারের কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেয়। তখন কমিটি ভবনটি বিক্রির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীসহ দেলোয়ারের নেতৃত্বে একদল লোক এসে ৪০ লাখ টাকায় ১৬০০ স্কয়ার ফিটের এই দ্বিতল ভবনটি নেওয়ার কথা বলে। এ সময় দেলু তার শ্বশুর মাদ্রাসার সভাপতি আবদুস সালামের হাতে ১০ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেন এবং বাকি টাকা সরকার থেকে পাওয়ার পর দেওয়া হবে বলেন।
এ সময় প্রতিবাদ করলে দেলু এবং তার বাবা গালিগালাজ করতে শুরু করেন। পরে তাদের লোকজন হই-হুল্লোড় করে উপস্থিত অনেকের সঙ্গে মারমুখী আচরণ শুরু করেন। অবস্থার অবনতি হলে মান সম্মানের ভয়ে সেখান থেকে তারা চলে যান।
মাদ্রাসার সভাপতি আবদুস সালাম এসব কথা স্বীকার করে বলেন, আসলে দেলোয়ারের স্ত্রী আমার মেয়ে নয়। এই মেয়েসহ তার শাশুড়িকে আমি বিয়ে করেছি। মাদ্রাসাটির ২০ শতাংশ জমি বাবদ ২৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৯ টাকা ও দ্বিতল ভবন বাবদ এক কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার ৬ টাকাসহ মোট এক কোটি ৯৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক আমিই গ্রহণ করি।
তিনি জানান, এত টাকার চেক হাতে পেয়ে হতবাক হন তিনি। নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমাও দেন তিনি। জমা দেওয়ার পর দিন ৩০ লাখ টাকা রেখে বাকি এক কোটি ৪২ লাখ টাকার চেক দেলোয়ারের বন্ধু আকরাম হোসেনের হাতে তুলে দেন তিনি।
অথচ জামাই (দেলোয়ার হোসেন) বলেছিলেন ৪০ লাখ টাকার বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। সরকার কীভাবে এত টাকা দিল তাও তিনি এখন বুঝে উঠতে পারছেন না।
মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ইমদাদুল হক বলেন, আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ, সভাপতিও খুব সহজ সরল মানুষ তারা কীভাবে কী করল সব কথা বলা যাবে না। এলাকার মানুষই পারে না, আমি আর কী প্রতিবাদ করব।
তিনি বলেন, মাদ্রাসায় ৮৪ জন ছাত্র রয়েছে। যে টাকা আমরা পেয়েছি তা দিয়ে অন্যত্র জমি ক্রয় করেছি কিন্তু ভবন তৈরির মতো অর্থ আর আমাদের হাতে নেই। যদি সবগুলো টাকা পেতাম তাহলে সেখানে ভবন তৈরি করেও আমাদের হাতে অনেক টাকা থাকত।
আক্ষেপ করে এই মাওলানা আরও বলেন, এতগুলো টাকা নিয়ে গেল অথচ এর অর্ধেক টাকা দিলেও এই এতিম অসহায়দের নিয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যেত। এখন মানুষের কাছে হাতপাতা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
এতগুলো মামলার আসামি, এতিমের টাকা লুট করা একজন চিহ্নিত অপরাধী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হয় কেমন করে এমন প্রশ্নের জবাবে পলাশ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন বলেন, মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের এভাবে ঠকানো তাদের ঠিক হয়নি।
এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ও ঘোড়াশাল পৌরসভার মেয়র আল মুজাহিদ হোসেন তুষারের সঙ্গে বলে এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এদিকে একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এসব ঘটনার সঙ্গে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, গণপূর্তভবন ও সড়ক বিভাগের একাধিক সরকারি কর্মচারীও জড়িত। দেলোয়ারের কাছে থেকে তারাও মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছেন।
এই ঘটনায় দেলোয়ারের সহযোগী ছিলেন এমন দুজন হলেন যুবলীগ নেতা মান্নান ও চরসিন্দুর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা আকরাম হোসেন। যদিও তারা বিষয়টি অস্বীকার করে জানিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অধিগ্রহণ শাখার কর্মচারীরাই দেলুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে দেলুকে সহায়তা করেছেন।
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ মাসুম বলেন, সরকারের অধিগ্রহণকৃত জমির পাশে দ্রুত এবং নতুন যেসব ভবন নির্মাণ হয়েছে তেমন কিছু ভবন সম্প্রতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে গত দুদিন ধরে আমাকে ফোনে নানাভাবে বাদ দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। জানি না এখানে আমি আর কতদিন থাকতে পারব।
এসব অনিয়মের সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ শাখা, গণপূর্ত ও সড়ক বিভাগের কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অধিগ্রহণ শাখার কোনো কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে ডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে চরসিন্দুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আকরাম হোসেনের নাম এসেছে বলে শুনেছি। ওই মাদ্রাসার ভবন কেনাবেচায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
রাতারাতি এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিশ্রম করে দুই স্ত্রীর জন্য দুটো বাড়ি বানিয়েছি মাত্র। এ ছাড়া আমার নামে একটি ইটাভাটা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই।
ডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেরুল হাই সাবের দেলু বাহিনীর নানা অত্যাচারের কথা স্বীকার করে বলেন, তার এসব অপরাধের কারণে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাভোগ করেছে। বের হয়ে আবার শুরু হয় নানা অপকর্ম। তবে এবার এতিমের প্রায় দেড়কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দ্রুত এ টাকা ফেরত পাবেন।
এদিকে ভুক্তভোগী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ থানায় এসে অভিযোগ করলে আইনগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পলাশ থানার পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ।