সারাদেশের বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৩৯ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলন দমাতে দেশজুড়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে। খুলনায় চলতি ডিসেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৮৩৫ নেতাকর্মীর নামে ১৪টি গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ৮৯ জন নেতাকর্মী কারাবন্দি রয়েছেন। আর এসব মামলার আসামিদের মধ্যে ১১০ জন হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন। এছাড়া খুলনার আদালত থেকে ৩১ জন জামিন পেয়েছেন।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এস এম শফিকুল আলম মনা বলেন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকে আকস্মিকভাবে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান শুরু করে। বিজয় দিবসকে সামনে রেখে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা এবং সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ মোকাবিলার নামে অভিযান চালানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারের লক্ষ্যে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, খুলনায় পুলিশ প্রশাসন চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে গায়েবি, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত অভিযোগে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে খুলনা মহানগরীর ৮ থানায় আটটি মামলা রয়েছে। সদর থানার মামলায় ৮০ জন, সোনাডাঙ্গা থানার মামলায় ৬০ জন, খালিশপুর থানার মামলায় ৫৫ জন, দৌলতপুর থানার মামলায় ৪৫ জন, খানজাহান আলী থানার মামলায় ৩০ জন, আড়ংঘাটা থানার মামলায় ৫০ জন, হরিণটানা থানার মামলায় ৪৫ জন এবং লবণচরা থানার মামলায় ৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে জেলার পাইকগাছা থানার মামলায় ৭০ জন, বটিয়াঘাটা থানার মামলায় ৮০ জন, ডুমুরিয়া থানার দুটি মামলার একটিতে ৬০ জন ও অপর মামলায় ৭৫ জন এবং রূপসা থানার দুটি মামলার প্রথমটিতে ৬০ জন ও দ্বিতীয়টিতে ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গায়েবি এসব মামলায় নগরীর ৪২ জন এবং জেলার ৪৭ জন নেতাকর্মী কারাবন্দি রয়েছেন।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে গত শনিবার সকালে হঠাৎই জামায়াত-শিবির যে মিছিল বের করে, সেখান থেকে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে নগর জামায়াতের আমীরসহ ১৮ জনের নামে মামলা হয়েছে। গত শনিবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় হওয়া এই মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২৫০ জনকে। এসআই কামরুজ্জামান খানের করা এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, যানবাহন চলাচলে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে নগর জামায়াতের আমীর মাওলানা মো. শাহজাহানকে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা সড়কে সমবেত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে গাড়ি ভাঙচুর, যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়া ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নাশকতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনার চেষ্টা করে। নোয়াখালীর সুধারামে পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে জামায়াত-শিবিরের ৩৬ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। গত শনিবার দিনগত রাতে সুধারাম মডেল থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোজাফ্ফর আলী বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে এই মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাইফুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আজ রবিবার সন্ধ্যায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন সুধারাম মডেল থানার ওসি মো. আনোয়ারুল ইসলাম।
আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে জেলা জামে মসজিদ মোড় এলাকায় জামায়াতের গণমিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা হয়। ওই ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে এই মামলা করা হয়। মামলায় ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। গত শনিবার সকালে আটক ২৩ নেতাকর্মীকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। রবিবার নোয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। যশোরের ঝিকরগাছায় পুলিশের করা একটি মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মাসে মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। জামিনের জন্য আদালতে আত্মসমর্পণ করে ১০ দিন করে হাজতবাস করতে হয়েছে। মামলা নিয়ে এই দৌড়াদৌড়ির বছর হতে চললেও এখনো আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা মামলার সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। বিএনপির নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে একে ‘গায়েবি’ মামলা বলা হচ্ছে। যশোরের ঝিকরগাছা পৌরসভা নির্বাচনের কয়েক দিন আগে গত ১ জানুয়ারি বিএনপির ৩৪ নেতাকর্মীকে আসামি করে ঝিকরগাছা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় ঝিকরগাছা থানাপুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এর মধ্যে একবার বদল হয়েছেন। মামলার এজাহারের তথ্যানুযায়ী, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পায়রাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গত ৩১ ডিসেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। পরদিন ১ জানুয়ারি ঝিকরগাছা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইনে বিএনপির ৩৪ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন পুলিশের এসআই সিরাজুল ইসলাম।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর রাতে ধ্বংসাত্মক ও সরকারবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতকারী জড়ো হয়েছেন বলে খবর পায় পুলিশ। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় তারা। আটক করা হয় তিনজনকে। বাকিরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যান। আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র। ঝিকরগাছা পৌরসভা নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ মামলা করা হয়। পৌরসভা নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডে বিএনপির ১১ জন কাউন্সিলর প্রার্থীকে ওই মামলায় আসামি করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর রাতে যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন ঝিকরগাছা পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হাসানুল কবির, গদখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মঈনুল ইসলাম ও ছাত্রদলের পৌর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম হোসেন।
এ বিষয়ে মামলার আসামি ঝিকরগাছা পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরমান হোসেন বলেন, ‘পুলিশ একটি গায়েবি মামলা দিয়ে দিয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ করে আমরা ১০ দিন করে জেল খাটলাম। এখন প্রতি মাসে একবার করে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। অথচ পুলিশের তদন্ত নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তদন্ত কর্মকর্তা কে, তা-ও আমরা জানি না। কোনো দিন আসামিদের কারও সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করেনি। এমনকি ঘটনাস্থলেও পুলিশের কেউ যায়নি। শুধু হয়রানি করার জন্যই পুলিশ ওই গায়েবি মামলা দিয়েছে, তা এখন একদমই পরিষ্কার।’ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হওয়া মামলাগুলো ‘গায়েবি’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পায়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শুধু রাজধানীতেই নাশকতার মামলা হয়েছিল ৫৭৮টি। প্রায় সব মামলার বাদী ছিল পুলিশ।
এসব মামলার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় পুলিশের ওপর ৯০টি হামলার ঘটনা ঘটে। উদ্ধার হয় ১ হাজার ১৮৬টি ককটেল ও ৩৭০টি পেট্রলবোমা। ঝিকরগাছা পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠছাড়া করতেই ওই মামলা করা হয়েছে বলে দলটির নেতাদের অভিযোগ। ঝিকরগাছা থানার এসআই সিরাজুল ইসলামের করা মামলায় ৩৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ৬০ থেকে ৭০ জনকে। আসামিদের মধ্যে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন ১১ জন। তারা বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী। নির্বাচনে পৌরসভার ৫ নম্বর (কীর্তিপুর) ওয়ার্ডের প্রার্থী ও বিএনপির নেতা আরমান হোসেন বলেন, ‘মামলা দিয়ে আমাদের ভোটের মাঠ ছাড়া করা হয়েছে। এ কারণে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে আমরা কেউ জয়ী হতে পারিনি।’