আইনজ্ঞদের অভিমত
রাজনৈতিক কারণে জামিন হচ্ছে না মির্জা ফখরুলের
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:১৭ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৫৭ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমানে যে অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন, প্রায় একই রকমের ৯০টি মামলায় এর আগে তিনি জামিন পেয়েছেন। একই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি দলটির নেতা আমান উল্লাহ আমানসহ কয়েকজন জামিন পেলেও এজাহারে নাম না থাকা মির্জা ফখরুলের আবেদন চারবার নাকচ হয়েছে। ফলে তার জামিন না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে আইন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলে।
আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তি জামিন পাওয়ার অধিকারী। সেই হিসেবেও জামিন পাওয়ার যোগ্য মির্জা ফখরুল। তাদের মতে, রাজনৈতিক কারণে তার জামিন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। এতে আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, মির্জা ফখরুল দেশের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশের ঠিক আগের দিন তাকে গ্রেফতার এবং বারবার তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করায় জনমনে এই ধারণাই প্রবল হচ্ছে- তার বিরুদ্ধে মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মির্জা ফখরুলের বয়স এখন ৭৬ বছর। তার স্বজন ও আইনজীবীরা বলছেন, তিনি নানা রোগে ভুগছেন। তাকে গত ১০ বছরে সহিংসতা সৃষ্টি, বিস্ফোরক বহন, গাড়ি পোড়ানো-ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা, সহিংসতায় হুকুমদানসহ নানা অভিযোগে মোট ৯২টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিএনপি এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছে। ইতিমধ্যে ৯০টিতেই জামিন পেয়েছেন তিনি। একটি মামলা খারিজ এবং সর্বশেষ রাজধানীর নয়াপল্টনের মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। একই ধরনের সব মামলায় জামিন পেলেও নতুন মামলায় কেন তার জামিন হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।
মির্জা ফখরুলের আইনজীবীরা বলছেন, সামাজিক অবস্থান, বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। জামিন না দিয়ে ন্যায়বিচার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, পল্টন থানায় পরিকল্পনা ও প্ররোচনার অভিযোগে করা মামলার দন্ডবিধির কয়েকটি ধারা জামিন অযোগ্য। এ কারণে তার জামিন হচ্ছে না। পল্টন থানার মামলায় সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুলের জামিন নামঞ্জুর করেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর আদালত। বিএনপির দাবি, আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম জামিনে থাকা মামলাগুলোতে প্রতি মাসেই হাজিরা দিতে আদালতে যান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি কারাগারে গেছেন অন্তত ছয়বার। একাধিকবার রিমান্ডেও নেয়া হয় তাকে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক বছর তাকে জেলেই থাকতে হয়েছে। এবারও গ্রেফতারের পর মির্জা ফখরুলের মতো হেভিওয়েট নেতাদের কারা ডিভিশন নিতে বেগ পেতে হয়েছে। উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তাদের। সেলের বাইরে তাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ বিএনপির।
ব্লাস্টের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না গণমাধ্যমকে বলেন, জামিন না দেয়া এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বোঝা যায়, বিচারব্যবস্থা অচল এবং এর পরিবর্তন আবশ্যক। আদালতকে তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচারপ্রার্থী কোনোভাবেই যেন হয়রানির শিকার না হন, তা বিবেচনা করতে হবে। মামলার এজাহারে যার নাম নেই, সুনির্দিষ্টভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই। অভিযোগের সম্পৃক্ততাও আদালতে প্রমাণ করতে হবে। সম্পৃক্ততা থাকলে আদালত তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিতে পারেন। রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতার কারণে জামিন না দেয়াটা সঠিক নয়। এভাবে বিচারব্যবস্থা চলতে পারে না। প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। নয়তো আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
মির্জা ফখরুলের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, আইনগতভাবে মির্জা ফখরুল জামিন পাওয়ার যোগ্য। শুধু রাজনৈতিক কারণেই তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। মির্জা ফখরুল একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। তিনি বোমাও মারেননি, তাঁর কাছে বোমা পাওয়াও যায়নি। জয়নুল আবেদীন জানান, উচ্চ আদালতের অবকাশকালীন ছুটি শেষ হলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জামিনের জন্য আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
ফৌজদারি মামলার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মির্জা ফখরুলকে যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, সেখানে এজাহারে তার নাম নেই। মামলার এজাহারে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ নেই। এজাহারে যাদের নাম ছিল, তাদের মধ্যে দুজন জামিনে গেছেন। একই আদালত মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদন নাকচ করছেন। এখানে মনে হয়, নিম্ন আদালত হয়তো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। বয়স ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় আদালত তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিতে পারতেন।
ফখরুলের আরেক আইনজীবী সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি অফিসের সামনে কথিত ঘটনার ১৪ ঘণ্টা পর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এখানে মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। তার পরও তাকে জামিন দেয়া হয়নি। জামিন পাওয়া তার আইনি অধিকার। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় উল্লেখ আছে- কাকে, কখন, কীভাবে জামিন দিতে হবে।
অবশ্য ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু গণমাধ্যমকে বলেন, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই জামিন অযোগ্য ধারা। সরকারি কাজে বাধা দেয়া, ভাঙচুর করা- এসবই জামিন অযোগ্য ধারা। তা ছাড়া সব মামলার আসামি এক রকম থাকে না। মামলায় ফখরুলের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, উস্কানিদাতা ও নির্দেশদাতার অভিযোগ আসছে। কাকে জামিন দেবে, কাকে দেবে না- এটি আদালতের এখতিয়ার। পিপি আরও বলেন, সরকারের প্রভাব থাকলে আমান উল্লাহ আমানসহ দুজনের জামিন হতো না। ফখরুলের অসুস্থতার কথা বলা হয়েছিল; আমরাও আদালতে বলেছি। কিন্তু যে মেডিকেল কাগজপত্র আদালতে দিয়েছে, সেগুলো পুরোনো। সাম্প্রতিক সময়ের কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট তারা আদালতে দিতে পারেননি।
জানা গেছে, এর আগে টানা ছয় মাস কারাভোগের সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মির্জা ফখরুলকে দ্রুত সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে হয়েছে। মির্জা ফখরুলের স্ত্রী রাহাত আরা গত সপ্তাহে কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওষুধপত্র ও কিছু বই দিয়ে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মির্জা ফখরুলের শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তিনি স্বামীর জন্য দোয়া করতে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন।
ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, কারাবন্দি নেতাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। তাদের ২৪ ঘণ্টা লকআপে রাখা হচ্ছে। বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় দেড় থেকে ২ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধর, কাজে বাধাদান, ভাঙচুর ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। পরদিন ভোর রাতে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে নিজ নিজ বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে পুলিশ। প্রায় সাত ঘণ্টা তারা সেখানে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলার কথা বলেনি পুলিশ। তবে ৮ ডিসেম্বর পুলিশ জানায়, ৭ ডিসেম্বরের নাশকতায় উস্কানি দেয়ায় ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর পর সিএমএম আদালত ও মহানগর আদালতে দফায় দফায় তাদের জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যায়।