নয়াপল্টন কার্যালয়ে পুলিশি তাণ্ডবে অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি : বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৪৮ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:২০ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
গত ৭ই ডিসেম্বরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি তাণ্ডবের ঘটনায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, গত ৭ই ডিসেম্বর নয়াপল্টন কার্যালয়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের বর্বর হামলা, ভাঙচুর, দ্রব্যাদি ও অর্থ লুণ্ঠন, গ্রেপ্তার এবং কার্যালয়ের আশপাশে বেপরোয়া গুলি ও টিয়ারগ্যাস, খুন, জখম ও নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অফিস থেকে ল্যাপটপ, কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, নথিপত্র, ব্যাংকের কাগজপত্র, নগদ অর্থ লুট করা প্রকৃত পক্ষে একটি ডাকাতির ঘটনা।
তিনি বলেন, ৭ই ডিসেম্বর পুলিশি হামলার পর পুলিশের ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর ও মালামাল লুটে অংশ নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এই ঘটনায় নগদ অর্থসহ ক্ষতি ও লুট হওয়া সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৫০,৮২,৫০০ (পঞ্চাশ লক্ষ বিরাশি হাজার পাঁচশত) টাকা।
আজ রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, কোন অফিস বা গৃহ তল্লাশির সময় মালিকপক্ষ এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সাক্ষী হিসাবে রাখার সাধারণ আইন অগ্রাহ্য করে পুলিশ যা করেছে তা হানাদার বাহিনীর আচরণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনায় জড়িত পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার, সাম্য ও সকল নাগরিকের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকাক্সক্ষা নিয়ে লাখো শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৭ই ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও আশে-পাশে অনির্বাচিত গণবিরোধী সরকারের নির্দেশে তার বিভিন্ন বাহিনীর যে নির্মম নিষ্ঠুরতা ও বর্বর আচরণ আপনারা ও আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন তা শুধু বিজয়ের মাসকে কলঙ্কিত করেনি, গণতন্ত্র হত্যাকারী ও বারবার গণতন্ত্র হত্যায় সহায়তাকারী বর্তমান ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকারের অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও গণবিরোধী পরিচয় উৎকটভাবে পুনরায় প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত গণমানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে এবং একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিপুল অস্ত্র সজ্জিত বিশাল সরকারী আইনশৃংখলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলীয় নেতা-কর্মী, এমনকি সাধারণ পথচারীদের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ, গুলি, টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড বোমা নিক্ষেপ করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মকবুল আহমেদকে হত্যা, অসংখ্য নেতাকর্মীকে মারাত্মকভাবে জখম করা এবং অফিসের ভিতর ঢুকে চেয়ারপার্সন, মহাসচিবসহ নেতাদের এবং দলও অঙ্গ দলের অফিস কক্ষ ভেঙ্গে তছনছ করা; কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন দ্রব্য লুট ও ভাংচুর, মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ও সিসি ক্যামেরাসহ আসবাবপত্র বিনষ্ট করা এবং এসব অপকর্মকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণের অপচেষ্টায় মিডিয়ার সামনেই ব্যাগে করে ককটেল বহণ করে তা’ অফিসের বিভিন্ন কক্ষে রেখে বিএনপি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, দলের মহাসচিবকে তার অফিসে ঢুকতে বাধা দিয়ে অফিসের সামনে তাকে ঘেরাও করে রাখা- এসব কিছুই আপনারা ও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। যে কোন সভ্য দেশে এমন সব ঘটনা শুধু অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রত নয়- এমন বর্বরতা ও ষড়যন্ত্রমূলক নিষ্ঠুরতা তীব্রভাবে নিন্দনীয়।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ঘটনার পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে যে ৪টি মামলা রুজু করেছে তার মধ্যে শুধু পল্টন থানায় করা ১০ নং মামলায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও আশেপাশ থেকে গ্রেফতারকৃত কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী, সাবেক মন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম, সাবেক এমপি খায়রুল কবীর খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, এ বি এম মোশারফ হোসেন, সেলিম রেজা হাবিব এবং এ্যাড. শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, সেলিম্জ্জুামান সেলিম, শাহ মো: নেছারুল হক, রফিকুল ইসলাম মাহতাব, আবুল কালাম আজাদ, হারুন অর রশিদ, মোস্তাক মিয়া, আব্দুল খালেক ও খন্দকার আবু আশফাকসহ ৪৫০ জন নারী ও পুরুষ নেতাকে গ্রেফতারকৃত আসামী উল্লেখ করে এবং আরও ১,৫০০ থেকে ২,০০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৭ জন নারী কর্মীও রয়েছেন।
অন্য ৩টি মামলায় গ্রেফতারকৃত ও অজ্ঞাত আসামী মিলিয়ে ৭ ডিসেম্বরের ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন সমূহের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
এর আগে দলের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন এবং ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিভাগীয় জনসমাবেশ থেকে ফেরার পথে যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু ও অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা নূরুল ইসলাম নয়নসহ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, ৮ ডিসেম্বর সকালে দলের মহাসচিব কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজ অফিসে যেতে চাইলে নাইটিঙ্গেল মোড়ে তাকে অন্যায়ভাবে বাধা দেয়া হয়। ঐ দিনই দিবাগত রাতে ভোর ৩টার দিকে উত্তরায় নিজ বাসভবন থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং শাহজাহানপুরে নিজ বাসভবন থেকে ঢাকার বিভাগীয় জনসমাবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র মির্জা আব্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সাদা পোশাকে তুলে নেয়া হয়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহসন করে বিকালে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এই ঘটনার পর গত কয়েক দিনে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১৩০০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব ঘটনা জনগণের তীব্র ঘৃণা ও অনাস্থার শিকার পতনোম্মুখে সরকারের স্বৈরাচারী কায়দায় টিকে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস বলেই দেশবাসী মনে করে।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, এত নির্যাতন, বর্বর অত্যাচার, জেল-জুলুম সত্ত্বেও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে দুর্বল করা যায়নি, বরং তা আরো বেগবান হয়েছে। ৭ ডিসেম্বরের পরে ঢাকা বিভাগের সর্বত্র সরকারী দল ও তার পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর নানা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে জনগণ ১০ ডিসেম্বরের জনসমাবেশ সফল করেছে। পরবর্তী প্রত্যেকটি কর্মসূচী সফল করেছে। আমরা সংগ্রামী দেশবাসী ও সাহসী নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
পুলিশ তাদের মামলায় বলেছে, বিএনপি নেতাকর্মীরা নাকি ইট-পাথর, বাঁশের লাঠি এবং ককটেল নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করেছে। বিপুল ও মারাত্মক সব আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক হাজার পুলিশকে ইট-পাথর, বাঁশের লাঠি ও তাদের ভাষায় ককটেল দিয়ে আক্রমণ করার মত হাস্যকর অভিযোগ জনগণ বিশ্বাস করে না। পুলিশের এজাহারেই বলা হয়েছে যে তারা ৭ ডিসেম্বর বিকালে মোট ১৭৯টি টিয়ারগ্যাস ও ৪৬০টি শর্টগানের গুলি ছুড়েছে এবং ৬টি সাউন্ড বোমা নিক্ষেপ করেছে। প্রকৃত পক্ষে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি।
এর বিপরীতে তাদের উপর আক্রমণকারী বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যবহৃত অস্ত্র হিসাবে আলামত দেখানো হয়েছে ফুটপাত ও রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ৫ বস্তা ইটের টুকরা (যা শহরের যে কোন সড়ক থেকে যে কোন সময় সংগ্রহ করা যায়), ৮০টি বাঁশের লাঠি (যা শহরের বহু স্থানে প্রকাশ্যে বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়) ও লালটেপে মোড়ানো কথিত ককটেলের ভঙ্গাংশ (যা ব্যবহৃত টিয়ার গ্যাসের শেল কিম্বা পথের আবর্জনারও অংশ হতে পারে)।
এমন অসম যুদ্ধের বিবরণ ছোটদের গল্প কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকদের প্রেসনোটেই শুধু দেখা যায়। তথা কথিত ক্রসফায়ারের গল্পের মতই এসব গল্প এখন শুধুই কৌতুকের খোরাক এবং অক্ষমের আর্তনাদ।
তিনি বলেন, দলের মহাসচিবকে অফিসের নিচে বসিয়ে রেখে এবং দলের অন্যান্য নেতাদের কয়েকটি কক্ষে আটকে রেখে অসংখ্য টিয়ারগ্যাস, গুলি, সাউন্ড বোমা নিক্ষেপ করে গোটা এলাকাকে রণক্ষেত্র বানিয়ে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা ও সদস্য দলীয় কর্মীর মত প্রতিপক্ষকে হেয় ও বিপদাপন্ন করার জন্য সাদা ব্যাগে করে নিজেরাই ককটেল নিয়ে মহাসচিবের ও জাসাস কার্যালয়ের টয়লেটে মোট ১৫টি ককটেল রেখে তা উদ্ধারের যে নাটক করেছে, মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়েছে।
একইসাথে আমরা বিএনপির সংগ্রামী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস সহ গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি ও বানোয়াট মামলা সমূহ প্রত্যাহারের দাবি করছি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।