বিদ্যুৎ খাতকে সরকার ‘বিলিয়নিয়ার’ তৈরির কারাখানায় পরিণত করেছে : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:২৬ পিএম, ২১ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:০৭ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিদ্যুৎ খাতকে সরকার ‘বিলিয়নিয়ার’ তৈরির কারাখানায় পরিণত করেছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সম্প্রতি জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় এবং সারাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আজ শুক্রবার সকালে বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘‘গত এক যুগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেন লুটপাটের মাধ্যমে বিলিয়নিয়ার বানানোর শিল্পে পরিণত হয়েছে। লোডশোডিং বেড়েই চলেছে। জাতীয় গ্রিডেও বিপর্যয় ঘটছে। প্রশ্ন হচ্ছে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ খাতে এতো বিপুল অর্থ ব্যয় করেও কেনো আজ বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার নসিহত দেয়া হচ্ছে? কেনো বিদ্যুৎ খাত আজ অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে?”
‘‘ উত্তর একটাই, এই সরকার একটা লুটেরা। তাদের(সরকার) লাগামহীন দুর্নীতি ও হরিলুটের খেসারত আজকে জনগণকেই দিতে হচ্ছে।”
গত ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রিডে বিপর্য়য়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘প্রায় দুই সাপ্তাহ পার হলেও এখনো বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। এই অদক্ষ সরকারের অপরিকল্পনাহীনতা, অপরিনামদর্শিতা ও জবাবদিহিতার কারণেই তারা এমন উদাসীনতা দেখাতে পারছে। পিজিসিবির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই তো মূখ্য নয়। লোক দেখানো গল্প-কথার প্রতিবেদন নয়। জাতি জানতে চায় কেন এই বিপর্য্য় ঘটলো এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্য্য় এড়াবার রোড ম্যাপ কি?’’
‘‘বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ নেট ওয়ার্ক ও গ্রাহক সংযোগ -এই চারটি মৌলিক স্তরেরর সুসমন্বয় করা হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সঞ্চালন যেখানে মাত্র ৬৯% ও ১৮০% বেড়েছে, সেখানে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৪১৭%। উৎপাদন পরিকল্পনার পরিনামদর্শিতার অভাবে মহাপরিকল্পনাটি এখন গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বিদ্যুতের অভাবে শিল্প-কলকারখানার চরম দুরাবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘নজিরবিহীন লোডশেডিংয়ের কারণে উচ্চমূল্যের ডিজেল জেনারেটর চালিয়ে কারখানা সচল রাখতে গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্চে। ঘন ঘন বিদ্যুত আসা-যাওয়ায় মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। গ্যাস নির্ভর বড় শিল্প যেমন সিরামিক্স টেক্সটাইলগুলো ধুকছে। জেনারেটর চালিয়ে স্পিনিং মিলগুলো সচল রাখা যাচ্ছে না।”
‘‘সরকার সব কিছুর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর করোনা সংক্রমণের দোষ দিয়ে পার পেয়ে যেতে চাচ্ছেন। অথচ করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক আগ থেকেই সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি খাদের কিনারায় চলে এসেছিলো।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসুর মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এখন যেটা চলছে সেটা লুটপাটের অর্থনীতি। এটাকে বলে আওয়ামী অর্থনৈতিক মডেল। বাংলাদেশে এখন আপনারা এই আওয়ামী অর্থনৈতিক মডেলের রিফলেকশন দেখতে পারছেন। ভবিষ্যতে আরো দেখতে পারবেন।”
‘বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র: সাদা হাতি’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘সরকারের অসৎ নীতির কারণেই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশে আগেও ছিলো। কিন্তু গত এক যুগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেন লুটপাটের মাধ্যমে বিলিয়নিয়ার বানানোর শিল্পে পরিণত হয়েছে।”
‘‘বিদ্যুত উৎপাদন না করেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এক দিকে চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ আমদানিও করা হচ্ছে। তাই শেয়ারবাজার পতনের মতো বিদ্যুৎ খাতে সংকট অনিবার্য ছিলো। প্রহর গুনছিলো কখন বিস্ফোরণ হবে। এখন সেই বিস্ফোরণ শুরু হলো।”
‘গ্রিড বিপর্যয়ের তদন্ত : উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘‘ আমাদের দেশে একটা কথা আছে না- উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দেয়া আরকি। চাকুরি গেলে তো পিজিসিবির এমডির যাওয়ার কথা, তারই তো সব খেয়াল করার কথা।”
‘‘ন্যাশনাল লোড ডিসপাস সেন্টার-এনএলডিসি স্থাপন হয়েছে অনেকদিন আগে। যেটা ডিজিটালাইজড করার কথা। যেটা দিয়ে সারা বাংলাদেশে বিদ্যুতের অবস্থা দেখবে কোথায় কি হচ্ছে। সেটাকে এনালগ করে রাখছে তারা। সুতরাং ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার জন্য সুবিধা হচ্ছে।এই ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য ডিজিটালাইজড করেন নাই। মোট কথা হচ্ছে পুরোটা চুরি আর জনগণ সেটা বহন করতে হবে।”
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়সহ সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের পদত্যাগ করা উচিত মন্তব্য করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘অবশ্যই তার(বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী) দায় আছে। তার তো পদত্যাগ করা উচিৎ। টেলিভিশনে দেখলাম উনি উল্টো প্রশ্ন করছেন, ফখরুল ও টুকু কি বুঝে এই টেকনিক্যাল বিষয়ে।”
‘‘আরে আমি সাড়ে ৪ বছর এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলাম। তাতে বিদ্যুতের প্রত্যেকটা জিনিস বুঝি। ওহ তো ১৫ বছর আছেন মন্ত্রী, ওর তো বুঝা উচিৎ আরো বেশি।”
বিএনপি ক্ষমতায় আসলে বিদ্যুতের এই অবস্থার পরিবর্তন আসবে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো চাঁদের চেরাগ না যে, আসলেই বিদ্যুৎ দেবো। তবে আমরা মেজার নেবো। আমাদের যে মাস্টার প্ল্যান ছিলো ওটাকে অনুসরণ করবো যাতে মানুষের উপরে ট্যাক্সেশন বেশি না হয়।”
প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন যে, বিএনপির আমলে এক মেগাওয়াট ও বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি –এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘ এটা তো উনি(প্রধানমন্ত্রী) বলেন। উনি ১৫ বছর ক্ষমতায় থাইকা জনগণকে বিদ্যুৎ দিয়া এখন তারা বিদ্যুৎ পায় না। ট্যাক্স দিতে হয় তার জন্য।”
‘‘আর আমাদের আমলে যতটুকু লোডশেডিং হইছে জনগণকে ট্যাক্স গুনতে হয় নাই।”
আইএমএফ ঋণ প্রসঙ্গে
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, বাজেট সহায়তার কথা বলে সরকার আইএসএফ ও এডিবির কাছে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এই স্বল্প পরিমান ঋণ দেশের দুই মাসের খরচ যোগান দেয়ার জন্য আসলে যথেষ্ট নয়।”
‘‘বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বর্তমান জ্বালানি সংকটের অন্যতম কারণ। সরকার বাপেক্সকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাস আবিস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই জাতির দুর্ভাগ্য যে ভাগ-বাটোয়ারার সুবিধার জন্য দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেল দেয়া হয়েছে।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘‘ওপেক কিংবা ওপেক প্লাস দেশগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনার জন্য বড় ও স্থায়ী সরবারহ চুক্তি করেনি সরকার। অথচ কমিশন খাওয়ার জন্য তেল উৎপাদনকারী নয় এমন বড় দেশ যেমন চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।”
‘‘অপর দিকে মোট আমদারির ৫০% স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনছে সরকার। কাতার ও ওমানের মতো দে্শের বড় গ্যাস সরবারহের চুক্তির অফার উপেক্ষা করে কমিশন খাওয়ার জন্য লোভে উচ্চদামে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস থেকে কিনছে সরকার।”