সরকার জ্বালানি খাতকে লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৯ পিএম, ২২ আগস্ট,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:০০ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সরকার জ্বালানি খাতকে লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের জ্বালানি বিষয়ক এক সেমিনারে বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘‘ আজকে যে জ্বালানি সংকট এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্ণীতি। এটা একটা বড় হাতিয়ার হয়েছে উইপন। সেই উইপন হচ্ছে- জ্বালানি খাতকে তারা বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে দুর্নীতির জন্য।”
‘‘শুধু জ্বালানি খাত কেনো? সমস্ত খাতকে, বাংলাদেশের কোনো খাত বাকি রাখেনি। আপনারা দেখেন কিছুদিন আগে কোভিডের সময় কিভাবে মানুষের জীবন নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে তারা দুর্নীতি করেছে? আপনারা দেখেছেন উত্তরায় গার্ডার পড়ে গিয়ে কিভাবে পাঁচ জনের জীবন গেলো, সেতু ও সড়ক খাতে দেখবেন সারাদেশে প্রতিদিন কয়েক‘শ মানুষ মারা যাচ্ছে দূর্ঘটনায়। ”
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘এই সরকার আমি যেটা বলার চেষ্টা করি এটা হচ্ছে, বর্গীদের সরকার। আমি ছোট বেলা গান শুনতাম, মা ঘুম পাড়াতেন ভয় দেখিয়ে যে, ছেলে ঘুমালো, পাড়া ঘুমালো বর্গী এলো দেশে। আজকে এরা(ক্ষমতাসীন দল) সেই বর্গীর ভুমিকা পালন করছে।”
‘‘আমাদেরকেও গান গাইতে হবে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্যে যে, আওয়ামী লীগ এলো দেশে – এই কথা বলে। এই জাতিকে এই দেশকে যারা ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিলাম, ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলো, ২ লক্ষ আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্ম চলে গিয়েছিলো বর্তমানের এই দেশকে দেখার জন্য নয়। আমরা একটা স্বাধীন- সার্বভৌম, একটা গণতান্ত্রিক সমাজ আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, একটা মুক্ত উদার গণতন্ত্রের মধ্যে আমরা বাস করতে চেয়েছিলাম। আজকে এরা কি করেছে? এরা সম্পূর্ণভাবে দেশটাকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।”
তিনি বলেন, ‘‘ কোথাও কথা বলতে পারবেন না, কোথাও লিখতে পারবেন, কোথাও যেতে পারবেন না। এমনকি গতকালকে প্রধানমন্ত্রী ধমক দিয়েই বলেছেন আরকি যে, কী আহ্বলাদ নির্বাচন করবেন। ভাবখানা এরকম যে, আপনারা আবার নির্বাচন করবার কে।”
‘বার বার চক্রান্তের কথা কেনো বলছেন’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ গতকাল ওই জায়গায়(২১ আগস্টের ঘটনাস্থলে) উনি(প্রধানমন্ত্রী) গেছেন। ওখানে উনি অনুষ্ঠান করেছেন, স্মরণ করেছেন, ওখানে চারদিকে ঘিরে দিয়ে। একেবারে সিকিউরিটি টেন্স তৈরি করে সেখানে করা হয়েছে। প্রশ্নটা হচ্ছে যে, এতো টেন্সে থাকতে হচ্ছে কেনো?”
‘‘ বার বার একথা বলছেন কেনো আবার সেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে, চক্রান্ত হচ্ছে? তাহলে কি দেশ আপনারা ১৫/১৬ বছরে ধরে চালালেন এবং বললেন যে, টেরোরিজমকে আপনারা উধাও করে দিয়েছেন। সেখাতে আবার সেই চিন্তা আসছেন কেনো? এরা প্রতিমুহুর্তে বাংলাদেশকে একটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যার মধ্য দিয়ে, প্রতারনার মধ্য দিয়ে, জনগনকে বোকা বানিয়ে এই দেশটাকে চালাচ্ছে।”
‘মানুষ জেগে উঠছে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আপনারা নিশ্চয় দেখছেন, এখন মানুষ কিন্তু নিজেরাই জেগে উঠতে শুরু করেছে। শেখ সুমন তাকে থানায় নিয়ে বলা হয়েছে যে, সে আত্মাহত্যা করেছে। কিন্তু আসলে তাকে অত্যাচার-নির্যাতন করেই মেরে ফেলা হয়েছে। জনগন আজকে নিজেরাই রাস্তা দখল করেছে, গেইট ঘেরাও করেছে, থানা ঘেরাও করেছে।”
‘‘ আজকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে আমাদের চা শ্রমিকরা নুন্যতম দাবি নিয়ে, ৩০০‘শ টাকা। সেখানে কিন্তু ১০ হাজার/১২ হাজার টাকা বেতনও তাদের আসে না। একদিকে ২৮শ টাকার পার ক্যাপিটাল ইনকাম, আরেক দিকে ১২০ টাকা বেতন।”
‘‘ এই যদি দেশ হয়, এই যদি একটা সমাজ হয়, এই যদি একটা অর্থনৈতিক হিসাব হয় তাহলে সেই স্বাধীনতার কোনো মূল্য আছে বলে আমরা মনে হয় না।”
আবারো সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে একটি জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে বিএনপির উদ্যোগে ‘দুর্নীতি জ্বালানি সংকটের উতস্য’ শীর্ষক সেমিনার হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন দলের স্থায়ী কমিটির খন্দকার মোশাররফ হোসেন যিনি ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের জ্বালানি ও বিদ্যুত মন্ত্রী ছিলেন। প্রবন্ধে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে এর বিরুপ প্রভাব, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষমতাসীনদের ব্যবসায়িক লুন্ঠনের চিত্র তুলে ধরা হয়।
বর্তমানে সৃষ্ট সংকট উত্তরণে জ্বালানি তেল আমদানিতে বর্তমান শুল্ক, কর বাবদ ব্যয়কৃত ৩৪% অনতিবিলম্বে মওকুফ, জ্বালানি তেলের মূল্য ৫ আগস্টের পূর্বাস্থায় পুণঃনির্ধারণ, রেশন কার্ডের বিপরীতে খাদ্য সরবারহ, ওএমএসের আওতায় নিত্য দ্রব্যের আইটেম বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্রদান, নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিস্কার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুত উতপাদন পলিসি গ্রহন, বিপিসিতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণসহ স্বল্প, মধ্য মেয়াদী ১৬ দফা করণীয় তুলে ধরা হয় প্রবন্ধে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘‘ সরকারের নিশিরাতের গণবিরোধী সিদ্ধান্তে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা এই সরকারের পক্ষে দেশের অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কেননা এদেশের জনগনের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই।”
‘‘ সরকার জনগনের চেয়ে তাদের নিজস্ব ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের স্বার্থকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেয়ায় সাধারণ জনগনের কাঁদে সমস্ত আর্থিক বোঝা চেপে বসেছে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে প্রবল গণ আন্দোলন গড়ে তুলে এই অবৈধ লুটেরা সরকারকে বিতাড়িত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।”
পরিবেশ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন বলেন, ‘‘ আজকে জ্বালানির নামে যে বিদ্যুতের উতপাদন করছি, একের পর এক কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র করছি সেটাও কিন্তু সুন্দরবন থেকে শুরু করে, মহেশখালী আরেকটা ক্রিটিকেল এরিয়াতেও একটা কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। যে পায়রাতে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র করলাম সেখানেও কিন্তু আমাদের পশু নদীসহ সুন্দবনের প্রাণ ও প্রকৃতির হুমকির সম্মুখিন।”
‘‘ আমি বিএনপির নেতৃবৃন্দকে বলতে চাই, আপনারা ক্ষমতায় আসবেন কি আসবেন না তার চেয়ে বড় কথা হলো আদর্শিকভাবে প্রাণ-প্রকৃতিকে আপনাদের টেকসই অগ্রগতির মেইন বেঞ্চমার্ক করা উচিত। সেটার ভিত্তিতে আপনাদের ভবিষ্যত যে পলিসি যেটা ফোকাস করা উচিত।”
তিনি বলেন, ‘‘ বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতের যে মাস্টার প্ল্যান করা হয়-এটা আমরা সব দেখি বিদেশী কোনো একটা কোম্পানি ও বিদেশী একটা সংস্থা দিয়ে করানো হয়। কেনো? বাংলাদেশে কী আমাদের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নেই? এই মাস্টার প্ল্যান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রাণ-প্রকৃতির সুনির্দিষ্টভাবে অগ্রাধিকার, আমাদের মানুষের অগ্রাধিকার। সেই অগ্রাধিকার কিভাবে কোনো একটা বিদেশী কোম্পানি নিশ্চিত করে। কখনোই না।”
‘‘ আমি এবারো দেখছি, মাস্টার প্ল্যানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জাইকার ফান্ডে এবং এটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে এলএনজিকে ইম্পের্ট করা হবে সেটাকে অগ্রাধিকার দেয়া। আমরা তো এলএনজি চাই না। আমরা চাই আমাদের সৌর বিদ্যুত, বায়ু বিদ্যুত, আমাদের বিশাল সমুদ্রে যে কারেন্ট আছে সেটাকে ব্যবহার করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। সেখানে বাংলাদেশসহ উন্নয়শীল দেশগুলো যদি আগামীতে তাদের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় তার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ বিদ্যুত তার নিজস্ব সক্ষমতায় তার দেশের ভেতরে উতপাদিত হতে হবে। তা না হলে হুমকির মুখে পড়বে। আমি মনে করি যে, বিএনপির যে ১২ দফা জ্বালানি নীতিমালা রয়েছে তাতে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত যে, ২০২৫ সালের মধ্যে অবশ্যই ১০০ শতাংশ জ্বালানির উতস্য হতে হবে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি।”
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনের সঞ্চালনায় সেমিনারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদার, অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সে(এ্যাব) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম রিজু, ইউনির্ভাসিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে বিএনপির সেলিমা রহমান, ইসমাইল জবিউল্লাহ, মশিউর রহমান, আবদুস সালাম আজাদ, শিরিন সুলতানা, সেলিম ভুঁইয়া, এবিএম মোশাররফ হোসেন, মীর সরফত আলী সপু, শাহ নেসারুল হক, তাইফুল ইসলাম টিপু, আকরামুল হাসান, শায়রুল কবির খান, সাংসদ রুমিন ফারহানাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।