পুঁজিবাজারের টাকা যাচ্ছে ডলার মার্কেটে!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:১৯ পিএম, ৩১ জুলাই,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:০৩ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
মূলধন হারানোর ভয়ে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতায় বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে গুজব চলছে। ফলে অনেকে ভয়ে-হতাশ হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর মধ্যে ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে অনেকে শেয়ার বিক্রির টাকা ডলারে বিনিয়োগ করছেন। ডলার ব্যবসায় নেমেই সপ্তাহের ব্যবধানে সাত থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত লাভও হয়েছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লাভের আশায় হুজুগে বিনিয়োগ করা অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। ইউসিবি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী আশিকুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, গ্রামীণফোন ও স্কয়ার ফার্মাসহ ভালো মৌলভিত্তিক ৮ কোম্পানির শেয়ারে আমার ২৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু গত ১০ দিনের দরপতনে আমার পুঁজি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ টাকায়। দিন যতই যাচ্ছে আমার টাকা ততই কমে যাচ্ছে। এখন শুনছি পুঁজিবাজার আরও পড়বে। তাই গত সপ্তাহে ১০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছি।
তিনি বলেন, ওই টাকার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে ডলার কিনেছি। ডলার প্রতি ৫ টাকা লাভ পেয়েছি। তিন দিনে এক লাখ টাকা লাভ হয়েছে। বাজারে অবস্থা ভালো না, যা আছে বিক্রি করে বেরিয়ে যাবো। নাম না প্রকাশের শর্তে ইবিএল সিকিউরিটিজের ট্রেডার বলেন, গত ৫ দিনে কমপক্ষে ২০ জন ক্লায়েন্ট তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে পোর্টফোলিও খালি করেছে। তারা এই টাকা ডলার মার্কেটে বিনিয়োগ করেবে বলে শুনেছি। আইপিডিসি সিকিউরিটিজের সিনিয়র কর্মকর্তা রাসেল সরকার বলেন, কিছুদিন আগে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত একটা ফেসবুক গ্রুপের লোকজন আমাকে ডলার ও স্বর্ণ কেনার জন্য বলেছিল। তারা যখন যে ইনফরমেন দেয় তা সত্যি হয়। যারা কিনেছে এখন তারা লাভ করছে। গোপনে খবর জেনে তারপর বিনিয়োগ করে ওই গ্রুপের লোকজন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে দরপতন হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও ডলার ও জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং বিশ্বমন্দার কারণে পুঁজিবাজারে দরতপতন হচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট ভলাটাইল (অস্থির) হয় অর্থাৎ ডলারের দাম বাড়ছে-কমছে। এখন ডলারের রেট ১শ টাকার ওপরে চলে গেছে। ফলে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে লাভের আশায় ডলার মার্কেটে বিনিয়োগ করছে অনেকে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই অবস্থা বিরাজ করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে সব টাকা উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তৈরি হয়েছে জ্বালানি সংকট। এ সংকটে অনান্য দেশের মতই বাংলাদেশের টাকার মান কমেছে। বেড়েছে ডলারের দাম। পাশাপাশি হঠাৎ করে দেশে লোডশেডিং বৃদ্ধি ও জ্বালানির মজুদ কমে আসছে, এমন খবর প্রকাশ হওয়ায় পুঁজিবাজারে পতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অপরদিকে ডলারের দাম বাড়ছে। ২৪ জুলাই খোলা বাজারে ১০৩ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার ডলার বৃহস্পতিবার ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে অর্থাৎ চার দিনের ডলারের দাম বেড়েছে সাত টাকা। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। এ কারণে পুঁজিবাজার ছেড়ে ডলার ব্যবসায় ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, চলতি মাসে পুঁজিবাজারে ১৩ কর্মদিবসের মধ্যে ১১ কর্মদিবসই দরপতন হয়েছে। এই দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৩৮৬ পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি কমেছে লেনদেন হওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন অর্থাৎ পুঁজি ৫ কিংবা ১০ হাজার নয় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে। অর্থাৎ দিন যতই যাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা ততই নিঃস্ব হচ্ছেন। তার বিপরীতে সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে সাত থেকে ১০ টাকা। ডিএসইর তথ্য মতে, ঈদের আগে ৭ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সেখান থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৫৯ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ ৭২ হাজার টাকায়। পক্ষান্তরে ওই সময়ে খোলা বাজারে ডলারের দাম ৯৮ টাকা থেকে ১১১ টাকা লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ ১৩ টাকা করে বেড়েছে। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন গণমাধ্যমেক বলেন, আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আস্থার অভাব, অকার্যকারিতা একই সঙ্গে বাজার অস্থির করে সেখান থেকে কিছু গোষ্ঠীর মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার কারণে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার।
তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে অচল। এটাকে সচল করতে হবে। চলমান ডলার বাজারের অস্থিরতায় হয়তো কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আস্থা বাড়াতে হবে।
এদিকে সংকটের এ সময়ে ডলার নিয়ে কারসাজি করলে সংশ্লিষ্ট মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৮ জুলাই সাংবাদিকদের এ কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি টিম মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো পরিদর্শন করে। এ সময় কিছু অনিয়ম চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যংকের কর্মকর্তাদের।
তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডলার নিয়ে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ডলার নিয়ে যারা কারসাজি করেছেন বা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ঋণের বিপরীতে সুদের হার তুলে নেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে তা আপাতত তুলে না নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ করা হয়েছে।
জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা শুনছি অনেকে এখন শেয়ারবাজারের মতো ডলার কেনাবেচা করছে। ডলার কিনে বাজারে সংকট সৃষ্টি করছে। এটি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছি আমরা। আমদানি বেড়ে যাওয়া এবং প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশে ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে এর দাম। ডলারের বিপরীতে ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে টাকার মান। ডলার মার্কেট স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে ৫০ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক দিন আগেও এ দাম ছিল ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। মে মাসের শুরুর দিকে ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। তবে খোলা বাজারে এক ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা থেকে ১১১ টাকায়। এর আগে গত রবিবার খোলা বাজারে দর ছিল ১০৫ টাকা। বাজারে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। মাঝে কমে এলেও গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে।