বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩১ পিএম, ২০ মে,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৫২ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক সমাজসহ দেশের সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বক্তব্যকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবর্হিভূত বক্তব্য বলে অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য চরম প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির নেতারা।
গত বুধবার ‘বঙ্গবন্ধু’ অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু তৈরি খাতে না হয় তার জন্য বাধা সৃষ্টিকারী ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা নদীতে দুটো চুবনি দিয়ে সেতুতে উঠানো এবং বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে ‘টুস’ করে ফেলে দেয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বৃহস্পতিবার নীলফামারীর সৈয়দপুরে এক কর্মিসভায় বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী অশালীন ও অরাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচ্ছন্নভাবে খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি। আমরা যারা রাজনীতি করি, রাজনীতি নিয়ে ভাবি, রাজনৈতিক চিন্তা করিÑ তারা কল্পনাও করতে পারি না একজন প্রধানমন্ত্রী এভাবে বিরোধী দলের নেত্রীকে হুমকি দিতে পারেন।’
শেখ হাসিনা অবৈধভাবে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে এখন ডাকাতের মতো কথা বলছেন বলে মন্তব্য করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ‘একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধির কথায় শালীনতা থাকা দরকার। তারপরও তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন। একটু ভদ্র হওয়া দরকার। গত বৃহস্পতিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সুস্থতায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর কথা যদি গুন্ডাপান্ডাদের মতো হয়, বিষয়টা কেমন হয়Ñ প্রশ্ন রেখে রিজভী বলেন, এই দেশ লুটেরারা চালাচ্ছে, মাফিয়ারা চালাচ্ছে। পদ্মা সেতু কী কারও পৈতৃক সম্পত্তি? কার টাকায় করেছেন? বাপের বাড়ি বা স্বামীর বাড়ির টাকা দিয়ে করেছেন? জনগণের টাকায় করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা নদীতে ‘টুস করে চুবানো দরকার’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য অশালীন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত উল্লেখ করে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, এ ধরনের কথা গুন্ডা-পান্ডাদের কথা। এগুলো তো পাড়া-মহল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কথা। দায়িত্বশীলদের কথা এমন নয়।
ডক্টর ইউনূসের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা তুলে ধরে তিনি বলেন, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বে সম্মান অর্জন করেছেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। তাকে নাকি পানিতে চুবাবেন? এটা যদি হয় প্রধানমন্ত্রীর কথা! দেশের বৃহত্তম যমুনা সেতু, লালন সেতু গোমতীর মেঘনা সেতু এগুলো কে করেছে? বেগম খালেদা জিয়া করেছেন। আপনার তৈরি সেতুতে যদি বিরোধীদলীয় নেতাকে টুস করে ফেলে দেন। তারা ক্ষমতায় এলে যদি আপনাকেও টুস করে ফেলে দেয়। আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা নারীবিদ্বেষী। আপনি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাননি। আপনার মুখে এমন বক্তব্য আসতেই পারে। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন রিজভী।
পদ্মা সেতুর শুরুর দিকের অর্থায়ন ও কাজ করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদ হাসান খান এক বিবৃতিতে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ‘বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে পদ্মায় ফেলে দেয়া উচিত’ বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য রেখেছেন তা আমাদের মর্মাহত করেছে। দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য গোটা জাতিকে লজ্জিত ও হতবাক করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অশ্রাব্য বক্তব্যে বহির্বিশে^র বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এভাবে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে? তারা কাদের কাছ থেকে শিখবে?
ইউট্যাবের নেতৃদ্বয় বলেন, এছাড়া শেখ হাসিনা আরো বলেছেনÑ ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের পেছনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা আছে। ফলে তাকেও পদ্মায় নিয়ে দুটি চুবানি দিয়ে উঠিয়ে নেয়া উচিত। মরে যাতে না যান, পদ্মায় একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়।’
নেতৃদ্বয় বলেন, একটি দেশের সরকারপ্রধানের মুখে যদি দেশের সম্মানিত ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত সিনিয়র নাগরিক সম্পর্কে এ ধরনের ঘৃণ্য মন্তব্য শোনা যায় তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হবে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং বিব্রতকর।
তারা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে দুজন ব্যক্তি নিয়ে বিরূপ ও অশালীন মন্তব্য করেছেন তারা উভয়েই স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য স্বমহিমায় ভাস্বর। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক। যিনি বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন। তার শাসনামলে বাংলাদেশের নারীর ব্যাপক ক্ষমতায়ন হয়েছে। নারীদের অবৈতনিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন মহতী কর্মকান্ড আজও মাইলফলক। তার স্বামী রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তাঁকে নিয়ে শেখ হাসিনা যে অশালীন মন্তব্য করেছেন তা নিঃসন্দেহে আমাদের সবাইকে মর্মাহত ও ব্যথিত করেছে।
অন্যদিকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বহির্বিশে^ সুনামের সাথে তুলে ধরেছেন। বিশে^র বহু দেশে তিনি আজও গর্বের সাথে চলাফেরা করেন। তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সত্যিই বেদনাদায়ক। সুতরাং আমরা শিক্ষক সমাজের পক্ষে আহ্বান জানাবোÑ রেষারেষি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনীতি করুন। যাতে নতুন প্রজন্ম কিছু শিখে এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক হয়।’