রাজপথে দুর্বার গণআন্দোলন করে সরকারকে হঠানোর বিকল্প নেই : বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৩ পিএম, ১৮ মে,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৪৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনায় বর্তমান অর্থনীতিতে ‘অশনিসংকেত’ দেখছে বিএনপি।
আজ বুধবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান যে অর্থনৈতিক অবস্থা যেটাকে আমি মনে করি এটা হচ্ছে এলার্মিং, এটা অশনিসংকেত আমাদের জন্য। অদূর ভবিষ্যতে আমরা যে শ্রীলংকার মতো বিপদে পড়তে পারি তার আশঙ্কাও আমাদের মধ্যে (স্থায়ী কমিটি) করা হয়েছে এবং সেই আশঙ্কা এখন আছে এবং এটাকে বাস্তবভিত্তিকই বলা যেতে পারে। গত ১৬ মে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্র্যালোচনা করে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে তা সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। এ সময়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রফতানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। ঢাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠেছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে আগামী দিনে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠবে। জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
সভায় নিম্নবর্ণিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় :
১। সভায় বিগত ৯ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পঠিত ও অনুমোদিত হয়।
২। সভায় ফ্যসিবাদ বিরোধী ঐক্য প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়।
৩। সভায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দেখা যায় যে, গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষকরে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রফতানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে। রিজার্ভ নিয়ে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। এটি দ্রুত কমে আসছে। গত ৮ মাসে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। পরের ২ মাসে এটা আরও ৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। এভাবে যদি রফতানির তুলনায় আমদানি বাড়তে থাকে এবং সেটা যদি রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করা না যায় তাহলে অতি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ শেষ হয়ে যাবে। রিজার্ভ শেষের কি ভয়াবহ পরিণতি শ্রীলংকার চলমান পরিস্থিতি তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। আমদানি যে হারে বেড়েছে, রফতানি সে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমে গেছে। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ বছরই আমদানি প্রায় ৮২-৮৫ বিলিয়ন ডলারে চলে যাবে, কিন্তু রফতানি প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। এই ৩২-৩৫ বিলিয়ন ডলারের যে বাণিজ্য ঘাটতি সেটা রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না। কাজেই এ বছরই ১০ বিলিয়ন ডলারের একটা ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে Balance of payment একাউন্ট বিপদের মুখে পড়বে। এদিকে টাকার মান ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার ছাড়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭-৮ টাকা কমে গেছে। ভবিষ্যতে টাকার মান আরও কমতে থাকবে। এক্ষেত্রে প্রতি মার্কিন ডলার ১০০ টাকার উপরে চলে যেতে পারে। আজ পত্রিকায় দেখলাম কার্ব মার্কেট প্রতি মার্কিন ডলার ১০৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে। সরকার ৬ দশমিক ২২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কথা বলছে। কিন্তু এটি বাস্তবতার সঙ্গে আদৌ সংগতিপূর্ণ নয়। তাছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। একই সঙ্গে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশি।
টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, এক বছরে পাম অয়েলের দাম ৬১ শতাংশ বেড়েছে। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫৮ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৫৬ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ৪৭ শতাংশ, অ্যাঙ্কর ৩১ শতাংশ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ। টিসিবির এই তথ্যই বলে দেয় সরকার ঘোষিত মূল্যস্ফীতির এ তথ্য সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশ। রিজার্ভ বিপজ্জনক লেভেলে চলে আসার কারণে টাকার দামও কমছে। সেক্ষেত্রে অর্থনীতিতেও সব কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। ক্রেতা সাধারণের ত্রাহি অবস্থা। তার ওপর রয়েছে সরকার দলীয় সিন্ডিকেটের তান্ডব। ইতিমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষ করে পাম ও সয়াবিন ওয়েলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এর আগে এত দাম বাড়েনি। ভরা মওসুমে চালের দাম যেখানে সবসময় স্বাভাবিক নিয়মে কমে যায় গত কয়েকদিনে তা অনেক বেড়ে গেছে।
গত মার্চে রফতানি আয় হয় ৪৭৬ কোটি ডলার; আর প্রবাসী আয় আসে মাত্র ১৮৬ কোটি ডলার। রফতানি ও প্রবাসী আয় মিলিয়ে মার্চে ৬৬২ কোটি ডলারের আয়ের বিপরীতে আমদানি দায় শোধ করতে হয় ৭১৪ কোটি ডলার। তাতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২ কোটি ডলার। আমদানি খরচ ও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করেছে সরকার। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৫২০ কোটি ডলার, এতে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। আমদানি খরচ এভাবে বাড়তে থাকলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক ব্যয়বহুল এ সব আমদানির সুযোগ নিয়ে ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বিপুল অর্থপাচার হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে রিজার্ভের হিসাব সঠিক নিয়মে করার। এতে রিজার্ভ কমবে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি। এখন রিজার্ভ রয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। আইএমএফের সুপারিশ মোতাবেক সঠিক নিয়মে রিজার্ভ হিসাব করলে বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ দাড়ায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। তাই বাস্তবিকভাবে আই এম এফ প্রণীত নিয়মে রিজার্ভ হিসাব করা হলে বাংলাদেশের হাতে আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে মাত্র সাড়ে তিন মাসের। যা একেবারেই alarming .
এদিকে সরকারের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে অসত্য কথা বলছে। ওগঋ মনে করছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবায়নে সমস্যা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ওগঋ. আইএমএফের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৬ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ৩৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত রীতি মেনে দীর্ঘদিন ধরে একই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করা হচ্ছে। এটি সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক ফর্মুলা অনুসরণ না করলে গ্লোবাল আউটলুকে বাংলাদেশ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আইএমএফ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার ৮ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। এছাড়া খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য উপস্থাপন হচ্ছে না। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয় গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। এই হার ৩-৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে।
সম্প্রতি একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ বলেছেন বাংলাদেশ সরকার ২৫.৪৫ বিলিয়ন সরকারি ঋণের তথ্য মোট সরকারি ঋণের হিসাব থেকে আড়াল করেছেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বর্তমান দেশটির ঋণ ১৩১.১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু পাবলিক প্রতিষ্ঠান, সরকার কন্টিনজেন্ট দায়, বাজেটবহির্ভূত অন্যান্য অর্থায়ন, সরকারের অভ্যন্তরীণ পারস্পারিক ঋণ (Inter-Governmental debt) এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম গ্যারান্টি যুক্ত বেসরকারি ঋণ হিসাব করলে মোট সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫৬.৫৯ বিলিয়ন। এবং জিডিপি ঋণের হার ৪৪.১%, যা সরকার বলে থাকে ৩৪.৭%। Sovereign guarantee যুক্ত বেসরকারি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ জানা গেলে সরকারি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে বলে এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন। এই চিত্র নিঃসন্দেহে alarming. সরকারি হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে এক লক্ষ কোটি ডলারের ওপর বৈদেশিক ঋণ রয়েছে বাংলাদেশের যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৪৯১০ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের মাথাপিছু যে বোঝা, ২০২৫ সাল থেকে রূপপুর পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলেই তা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। ২০ বছর ধরে এ প্রকল্পের জন্য প্রতিবছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার।
বর্তমান গণস্বার্থ বিরোধী আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের ব্যক্তিগত অর্থের ঝোলা ভর্তি করতে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি। ইতিমধ্যেই দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা এসব প্রকল্পকে জনগণের জন্য ঋণের বোঝা ভারী করার শ্বেত-হস্তি প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অন্যতম। রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য রূপপুর প্রকল্পটি কার স্বার্থে বাস্তবায়ন হচ্ছে জনমনে প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। অথচ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আরো অনেক কম খরচে বিকল্প পন্থায় উৎপাদন করা যেত। রাশিয়া ভারতে প্রায় একই ক্যাপাসিটির পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় বাংলাদেশের অর্ধেক। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাংলাদেশ এত বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে? তাই আমরা জানতে চাই, এ ঋণ পরিশোধে ২০ বছর সময় লাগবে বলে সরকারিভাবেই জানানো হচ্ছে। কিন্তু ২০২৫ সাল থেকে বার্ষিক কিস্তি ৫৬৫ ডলার দিতে থাকলে বাংলাদেশকে সুদাসলে কত অর্থ পরিশোধ করতে হবে তা জনগণকে জানানো হোক।
একই সঙ্গে দুটো রেলপথ প্রকল্প : ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের অর্থনৈতিক “ফিজিবিলিটি” ভবিষ্যতে খুব বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার তেমন সুযোগ নাই। ফলে ভবিষ্যতেও রেলপথটি “আন্ডার-ইউটিলাইজড” থেকে যাবে। অতএব, ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য আয় দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা চীনা ঋণের অর্থে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। একই অবস্থা চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প নিয়ে। এ রেলপথও অদূরভবিষ্যতে “আন্ডার ইউটিলাইজড” থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ রেলপথের আয় দিয়ে কখনই প্রকল্পটির ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে না। এ সকল প্রকল্প অনতিবিলম্বে বন্ধ করা হোক।
এই যখন অবস্থা তখন টাকা পাচারে রেকর্ড সৃষ্টিকারী বর্তমান সরকারের মাথায় সাম্প্রতিককালে অত্যন্ত ব্যয়বহুল গ্ল্যামারাস প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা গেড়ে বসেছে। যেসকল প্রকল্প প্রস্তাব এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, তা হল- ১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন। ২) দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ৩) পূর্বাচলে ১১০ তলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স। ৪) শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ৫) পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু। ৬) নোয়াখালী বিমানবন্দর। ৭) দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প এবং ৮) ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর। এ মুহূর্তের বাস্তবতায় এ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হবার দরকার নাই। যেকোনো সাধারণ জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন দেশপ্রেমিক নাগরিকই তা অনুভব করতে পারে। অনতিবিলম্বে এসব প্রকল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা হোক, তা না হলে শ্রীলংকার ভাগ্য বরণের কোনো বিকল্প থাকবে না।
৪। সম্প্রতি বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থ আত্মসাৎকারী পি কে হালদার ভারতে গ্রেফতার হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সভায় আলোচিত হয়েছে। সভা মনে করে সরকারের শীর্ষ মহলের প্রত্যক্ষ মদদ, প্রশ্রয়, আশ্রয় ও অংশীদারিত্বে পি কে হালদারের মতো অর্থ আত্মসাৎকারীর সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কোনোক্রমেই প্রায় ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো আর্থিক জালিয়াতি করে দেশ থেকে নির্বিঘেœ পলায়ন করা সম্ভব নয়। আর কত অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারী পিকে হালদাররা রয়েছে যারা এখনও ধরা পড়েনি, জনগণ তা জানতে চায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, পি কে হালদার যে দুটি প্রতিষ্ঠানের (রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের) এমডির দায়িত্বে ছিলেন তার মালিকানার সাথে বাংলাদেশের “আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়া” শিল্প গ্রুপগুলো জড়িত। মানুষ মনে করে এদের অনেকের সাথে দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর পরিবারের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এ ধরনের অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার সম্ভব নয়। এর সত্যতা প্রমাণিত হয় যখন এরকম একজন ভয়ংকর আর্থিক লুটেরার গ্রেফতারের সংবাদে সরকারের মন্ত্রীরা দায়সারা ও সাদামাটা গতানুগতিক মন্তব্য করে দায় এড়িয়ে যান। কথা হচ্ছে delay-dally tactics কেন। আমাদের প্রশ্ন এক্ষণি extraditation -এর আওতায় তাকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশে বিচার করা হবে না কেন? তার সাথের গডফাদার ও তার সহযোগীদের এখনও গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? সরিষায় যখন ভূত থাকে অর্থাৎ যারা পাকড়াও করবেন তাদের অনেকেই যদি এ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারে সহযোগী হয় তা হলে কারা ধরবে এদের। এই যে culture of impunity এতেই দেশের সর্বনাশ হচ্ছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রয়েছে শীর্ষ থেকে গ্রাস-রুট পর্যন্ত সরকারি লোকজন।
৫। সভায় স্যাটেলাইট- ১ গত ৪ বছরেও কোনো অর্থ আয় করতে না পারার বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল ও গ্লামারস উন্নয়নের ডামাডোল বাজাতেই এধরনের অপরিণামদর্শী প্রকল্প গ্রহণ করে দেশকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়েছে। স্যাটেলাইট-১ তৈরি এবং উৎক্ষেপণে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। আমাদের সকলের স্মরণে আছে, উৎক্ষেপণের সময় বলা হয়েছিল, পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে এই অর্থ তুলে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের চার বছর পূর্তিতে এসে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘চার বছরের মধ্যে প্রথম তিন বছরে আমরা নানা কারণে কোনো আয় করতে পারিনি। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা আয় করতে শুরু করছি।’
এদিকে এক সাম্প্রতিক প্রেস স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে ৩০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে ফড়সবংঃরপ ংড়ঁৎপব থেকে। সব চেয়ে হতাশার কথা হচ্ছে, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ‘এজন্য এখন তারা দেশের ভেতরে নতুন বাজার মানে কাজের ক্ষেত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে’। এর অর্থ হচ্ছে, স্যাটেলাইট-১ থেকে অর্থ উপার্জনের প্রধানমন্ত্রী ও তার পুত্র প্রযুক্তি উপদেষ্টার স্বপ্ন এখন দেশবাসীর জন্য এক আর্থিক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কারণ প্রকল্পের জন্য গৃহীত ঋণের টাকাতো আমার আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা আয় থেকে প্রদত্ত ট্যাক্স, ভ্যাটের অর্থেই পরিশোধ করা হয়েছে এবং হবে। স্যাটেলাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের নিয়োগ না দিয়ে দলবাজ কিংবা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের স্বজন তোষণের ফলে সরকার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ফেইল করেছে যা দেশকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার বলে সভা মনে করে। বর্তমান স্যাটেলাইটের যখন এই হতাশ চিত্র তখন আবার নতুন করে আর একটি স্যাটেলাইট প্রকল্প গ্রহণের পাঁয়তারা চলছে। শ্বেত-হস্তি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পটি আর্থিকভাবে অলাভজনক ও বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও নতুন করে দক্ষিণবঙ্গে আর একটি আণবিক প্রকল্প গ্রহণের প্রাথমিক কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। ভোটারবিহীন ও সর্বোপরি জনগণের কাছে জবাবদিহিতাহীন বর্তমান অবৈধ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আর্থিক লোভ-লালসা ও দুর্নীতির পরিসর এতই বেড়ে গেছে যে, তারা জনকল্যাণের তোয়াক্কা না করে জনগণের অর্থ লুট-পাটে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সভা মনে করে বর্তমান বিভীষিকাময় অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার জন্য বর্তমান জবাবদিহিহীন এই অবৈধ সরকারই দায়ী। আগামীতে তাদের জনগণের অর্থ লুটের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। দেশকে রক্ষার জন্য মানুষকে বাঁচানোর জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এ মুহূর্তে সর্বজনীন ঐক্যের মাধ্যমে রাজপথে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে অনতিবিলম্বে এ সরকারকে হঠানোর কোনো বিকল্প নেই।