দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের জন্য অশনিসংকেত : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:২৩ পিএম, ১৮ মে,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২২ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচক পর্য়ালোচনায় বর্তমান অর্থনীতিতে 'অশনিসংকেত' দেখছে বিএনপি।
আজ বুধবার (১৮ মে) বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ''বাংলাদেশের বর্তমান যে অর্থনৈতিক অবস্থা যেটাকে আমি মনে করি এটা হচ্ছে এলার্মিং, এটা অশনিসংকেত আমাদের জন্য। অদূর ভবিষ্যতে আমরা যে শ্রীলংকার মতো বিপদে পড়তে পারি তার আশঙ্কাও আমাদের মধ্যে (স্থায়ী কমিটি) করা হয়েছে এবং সেই আশঙ্কা এখন আছে এবং এটাকে বাস্তবভিত্তিকই বলা যেতে পারে।"
গত ১৬ মে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্য়ালোচনা করে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে তা সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ''বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রুপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠেছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে আগামী দিনে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠবে।"
তিনি বলেন, রিজার্ভ নিয়ে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। এটি দ্রুত কমে আসছে। গত আট মাসে রিজার্ভ ৪৮ বিলয়ন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। পরের দুই মাসে এটা আরো ৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। এভাবে যদি রপ্তানির তুলনায় আমদানি বাড়তে থাকে এবং সেটা যদি রেমিট্যান্স দিয়ে পুরণ করা না যায় তাহলে অতি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ শেষ হয়ে যাবে। রিজার্ভ শেষ হওয়ায় কি ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে শ্রীলংকার চলমান পরিস্থিতি তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ।"
বাংলাদেশে এই মুহুর্তে যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ''আমদানি ব্যয় আমাদের বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। আমদানি যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি যে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমে গেছে। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।"
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ 'এলার্মিং' অবস্থায় উল্লেখ করে অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক মির্জা ফখরুল বলেন, ''আইএমএফের সুপারিশ মোতাবেক সঠিক নিয়মে রিজার্ভ হিসাব করলে বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবিকভাবে আইএমএফ প্রনীয় নিয়মে রিজার্ভ হিসাব করা হলে বাংলাদেশের হাতে আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে মাত্র সাড়ে তিন মাসের। যা একেবারেই অশনিসংকতে।"
বর্তমান এই অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ''বিএনপির স্থায়ী কমিটি মনে করে বর্তমান বিভীষিকাময় অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার জন্য জবাবদিহিহীন এই অবৈধ সরকারই দায়ী। দেশকে রক্ষার জন্য, মানুষকে বাঁচানোর জন্য, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এই মুহুর্তে সার্বজনীন ঐক্যের মাধ্যমে রাজপথে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে অনতিবিলম্বে এই সরকারকে হটানোর বিকল্প নাই।"
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ''ডলারের দাম ১'শ ছাড়িয়েছে। পত্রিকায় দেখলাম, কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১৯৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বানিজ্য এবং মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে। সরকার ৬ দশমিক ২২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কথা বলছে। কিন্তু এটি বাস্তবতার সঙ্গে আদৌ সংগতিপূর্ণ নয়।শহরের চেয়ে গ্রামের মূল্যস্ফীতি গ্রামে বেশি। খাদ্য বর্হিভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশ। রিজার্ভ বিপদজনক লেভেলে চলে আসার কারণে টাকার দামও কমছে। সব কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। ক্রেতা সাধারণের ত্রাহি অবস্থা। তার উপরে সরকারের দলীয় সিন্ডিকেটের তান্ডবে ইতিমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষ করে পাম, সয়াবীন তেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ভরা মৌ্সুমে চালের দাম যেখানে সবসময় স্বাভাবিক নিয়মে তমে যায় সেখানে গত তিন দিনে অনেক বেড়ে গেছে।"
দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ''বর্তমান গণস্বার্থ বিরোধী ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের ব্যক্তিগত অর্থের ঝোলা ভর্তি করতে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়ন করছে। মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা এসব প্রকল্পকে জনগনের ঋণের বোঝা ভারী করার শ্বেত হস্তী প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারমধ্যে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি হয়ে কক্সবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র ২ হাজার ৪'শ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য রুপপুর প্রকল্পটি কার স্বার্থে বাস্তবায়ন হচ্ছে জনমনে প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। আমরা জানতে চাই, ২০১৫ সাল থেকে বাতসরিক কিস্তি ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার দিতে বাংলাদেশকে সুদাসলে কত অর্থ পরিশোধ করতে হবে তা জনগনকে জানানো হোক।"
ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মনাধীন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারি-কক্সবাজার, ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প দুইটি অর্থনৈতিক 'ফিজিবিলিটি' ভবিষ্যতে খুব লাভজনক নয় বিধায় এই প্রকল্প দুইট অনতিবিলম্বে বন্ধের দাবিও করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির বৈঠক বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, দ্বিতীয় পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প, পূর্বাচলে ১১০ তলা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তরজাতিক বিমান বন্দর, পাটুয়ারি-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, নোয়াখালী বিমানবন্দর, দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উতক্ষেপন প্রকল্প এবং ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর এ্ই ৮টি সরকারের সম্ভাব্য প্রকল্পকে 'গ্ল্যামারাস' প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করে এসব প্রকল্প বন্ধের দাবি জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ''এই মুহুর্তের বাস্তবতায় এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হবার দরকার নাই। অনতিবিলম্বে এসব প্রকল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা হোক। তা নাহ।েল শ্রীলংকার ভাগ্য বরণের কোনো বিকল্প থাকবে না।"
মেগা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঁচার এবং দেশকে বিদেশী ঋণ নির্ভর করে ফেলা হয়েছে বলেও দলের স্থায়ী কমিটি মনে করেন বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ''স্যাটেলাইট-১ তৈরি ও উতক্ষেপনে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিলো। গত ৪ বছরেও কোনো অর্থ আয় করতে পারেনি। স্থায়ী কমিটি মনে করে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল ও গ্ল্যামারস উন্নয়নের ডামাডোল বাজাতেই এই ধরনের অপরিনামধর্শী প্রকল্প গ্রহন করে দেশকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়েছে। এক সাম্প্রতিক প্রেস স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে গত তিন বছরে ৩শ কোটি টাকা আয় হয়েছে অভ্যন্তরীন উতস্য থেকে। সবচেয়ে হতাশার কথা হচ্ছে, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য এখন তারা দেশের ভেতরে নতুন কাজের ক্ষেত্রে বের করার চেষ্টা করছে। এর অর্থ হচ্ছে স্যাটেলাইট -১ থেকে অর্থ উপার্জনের প্রধানমন্ত্রী ও তার পুত্র তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টার স্বপ্ন এখন দেশবাসীর জন্য এক আর্থিক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বর্তমান স্যাটেলাইটের যখন এই হতাশ চিত্র তখন আরেকট স্যাটেলাইট প্রকল্প গ্রহনের পায়তারা চলছে।"
স্যাটেলাইট প্রকল্পে অভিজ্ঞদের নিয়োগ না করে দলবাজদের নিয়ে এর কর্মকান্ড পরিচালনার বিষয়টি তদন্তের দাবিও জানান তিনি।