হাওর অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচারের দাবি মির্জা ফখরুলের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪৮ পিএম, ১৭ মে,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৫৬ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণের নামে হাওর অঞ্চলে সরকারি অর্থ লুটের মহোৎসব চলে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজ আমরা এমন এক বিষয় নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি যখন দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক বিপর্যস্ত ও দিশেহারা। ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশে মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা কৃষক পরিবারের সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক ও দুর্বিষহ। এর মধ্যে চলতি মওসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণাসহ কয়েকটি জেলার হাওরের লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল। সেই সাথে ভেসে গেছে প্রান্তিক সেসব জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার স্বপ্ন। হাওর এলাকার সাড়ে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে কেবলমাত্র একটি ফসল হয়। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের কারণে কোনো বছর সেটি তলিয়ে গেলে সারাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। হুমকিতে পড়ে জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভারতের চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও সুরমা নদী দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এ জেলায় পাহাড়ি ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হাওরের বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি ঢলের পানির চাপে ভাটি এলাকার বাঁধও এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জে ১৯টি হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার তাহিরপুর, শাল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা, মধ্যনগর উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বছরের একটি মাত্র ফসল পানিতে ডুবে যাওয়ায় এখন সর্বস্বান্ত ও দিশেহারা হাওরের কৃষিজীবী মানুষ। সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অধিদফতর জানিয়েছে, এসব উপজেলায় ৫৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গিয়ে এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তবে কৃষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ ও ইউপি চেয়ারম্যানগণ জানান এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নেত্রকোণায় মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে খালিয়াজুরির ধনু নদীর পানিতে ডুবে গেছে প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
তিনি বলেন, চলতি বছরে সুনামগঞ্জ জেলায় বাঁধ নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১২২ কোটি টাকা এবং গত ৫ বছরে এই টাকার পরিমাণ ছিল ৬২১ কোটি টাকা, যা বাঁধ রক্ষায় তেমন কোনো কাজে আসেনি। বরং এই বরাদ্দকৃত টাকা ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা এই টাকা হরিলুট করেছে। যে সমস্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা এতই দুর্বল যে, মাত্র ২৪ ঘন্টার পানির চাপ সামলাতে পারেনি। প্রতি বছর এভাবে বাঁধ নির্মাণের নামে হাওর অঞ্চলে সরকারি অর্থ লুটের মহোৎসব চলে। এর ফলে কৃষকরা হয় সর্বস্বান্ত, অপরদিকে সরকারি দলের লোকজন ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা হয় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সুনামগঞ্জ জেলার হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটির গবেষণা সূত্র অনুযায়ী বিভিন্ন উপজেলায় ৭২২টি বাঁধের মধ্যে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০৮টি বাঁধের ওপর পরিচালিত জরিপের ফল অনুযায়ী মাত্র ৮ শতাংশ বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন হয়, ঘাস লাগানো হয় মাত্র ৩ শতাংশ বাঁধে। সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধ নির্মাণের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ শতাংশ বাঁধেই এই নিয়ম তোয়াক্কা করা হয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সুনামগঞ্জে মোট ১৭১৮ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, শুধু দেশের হাওর অঞ্চলই নয়, এই চিত্র দেশের সার্বিক কৃষি সেক্টরে। বর্তমান অবৈধ সরকারের আমলে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলু চাষিরা তাদের আলুর ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ জানানোর খবরও কেউ ভুলে যায়নি। এর আগে কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদে পাকা ধানের জমিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে ফসলের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ফসলের ক্ষেতে ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে হতাশাগ্রস্ত কৃষক শফিউদ্দিন আত্মহত্যা করে এক অভিনব ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, একই দাবিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে দুই আদিবাসী কৃষক রবি মারন্ডী ও অভিনাথ মারন্ডী কীটনাশক পানে আত্মহত্যার কথাও দেশবাসী ভুলে যায়নি।
তিনি আরো বলেন, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এদেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ এখনও সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা নেই। আওয়ামী সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলে জনগণের নিকট তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তারা সবসময় ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে বলেই জনকল্যাণে কোনো কাজ করে না। যার ফলে তাদের শাসনামলে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ সবসময়ই বঞ্চিত, অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকেছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কৃষকদলের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন ও কৃষকদের দুর্দশার চিত্র দেখে এসেছেন। সরকারি দুর্নীতিরোধ, হাওরের কৃষকদের দুর্দশা লাঘব ও শস্য নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের কতিপয় সুপারিশ আমি এখন আপনাদের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরছি।
সুপারিশসমূহ :
১। হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
২। বছর বছর বাঁধ নির্মাণ না করে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরিকৃত ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
৩। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনা সুদে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। ঋণগ্রস্ত কৃষকের ঋণের সুদ মওকুফ এবং স্বাভাবিক অবস্থা না ফেরা পর্যন্ত ঋণের কিস্তি নেয়া বন্ধ করতে হবে।
৫। হাওর অঞ্চলে শস্য বীমা চালু করতে হবে।
৬। হাওর অঞ্চলের কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য গণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৮। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সাবেক সংসদ সদস্য নাজিমুদ্দিন আলম, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক শরাফত আলী সপু, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবতী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী শাওখায়াত হোসেন নান্নু, সহ-সাধারণ সম্পাদক এম জাহাঙ্গীর আলম, দফতর সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক, কুটির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নাঈম প্রমুখ।