সিট দখল করতে গিয়ে পেটালেন ইডেনের ছাত্রলীগ নেত্রী, হচ্ছেন বহিষ্কার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৮ পিএম, ১২ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩৮ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর ইডেন সরকারি মহিলা কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসে (হল) সিট দখল করতে গিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের এক নেত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযুক্তের নাম নুজহাত ফারিয়া রোকসানা। তিনি কলেজের গণিত বিভাগের ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী। রাজনীতিতে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী ও ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। মারধরের ঘটনায় কলেজ ও ছাত্রীনিবাস থেকে অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর বহিষ্কারাদেশ চেয়ে সোমবার (১১ এপ্রিল) দুপুরে অধ্যক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নুজহাতকে ছাত্রীনিবাস থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আবেদনপত্রে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, গত ১০ এপ্রিল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসের পঞ্চম তলার ৫০৭ নম্বর কক্ষে সিট দখল করতে সেই কক্ষের বৈধ ছাত্রীদের ওপর হঠাৎ হামলা করেন কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য নুজহাত ফারিয়া রোকসানা ও তার অনুসারীরা। তখন চার নম্বর বেডের বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থী ফারিয়া হক অর্পিতাকে ছাত্রলীগের ওই নেত্রী (নুজহাত ফারিয়া রোকসানা) ও তার অনুসারীরা মারধর করেন। এক পর্যায়ে মারধরের শিকার ওই শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ ঘটনায় রুমের বাকি সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে দুইজন মাস্টার্সের পরীক্ষার্থীও ছিলেন। শুধু বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীরাই নয় বরং ক্যাম্পাসে প্রত্যেক সাধারণ ছাত্রীই নিয়মিতভাবে তার (নুজহাত ফারিয়া রোকসানা) উশৃঙ্খল আচরণের জন্য সবসময় ভীত থাকেন। এছাড়াও ওই ছাত্রলীগ নেত্রী অবৈধভাবে হলের কক্ষ দখল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণের হুমকি দেয়া, অবৈধভাবে বহিরাগত মেয়েদের দিয়ে সিট দখল করা, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ, জিনিসপত্র ভাঙচুর, টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র চুরি, মেয়েদের জোরপূর্বক রাজনীতিতে জড়ানো, মেয়েদের জোর করে আপত্তিকর ছবি তোলা ও বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ম করেন বলেও আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, নুজহাত ফারিয়া রোকসানা ছাত্রীনিবাসের সিট বাণিজ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি সিট পাইয়ে দেয়ার নামে নতুন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকেন। একই কারণেও এ ঘটনার সূত্রপাত। গত শনিবার (৯ এপ্রিল) নতুন এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ৫০৭ নম্বর কক্ষে বৈধ শিক্ষার্থীদের সিট থেকে সরিয়ে নতুন শিক্ষার্থীকে দেয়ার জন্য বলেন। ওই কক্ষের বৈধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে তখনই তাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হন নুজহাত। এরপর হল সুপার নাজমুন নাহারের নেতৃত্বে চারজন সহকারী তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক সেখানে যান। উশৃঙ্খল আচরণের কৈফিয়ত চাওয়ার এক পর্যায়ে তার সঙ্গে শিক্ষকদের ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় আসমা আক্তার নামের এক সহকারী তত্ত্বাবধায়কের পেছনে হাতমোড়া দিয়ে ধরেন। পরে তার বাজে আচরণের কারণে শিক্ষকরা সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। সেদিন সফল না হলেও পরদিন রবিবার ইফতারের পরপরই ওই কক্ষে আবারও আসেন নুজহাত ফারিয়া রোকসানা। কোনো কথা ছাড়াই চার নম্বর সিটের যাবতীয় জিনিসপত্র মাটিতে ফেলে দেন। কারণ জানতে ফারিয়া হক অর্পিতা এগিয়ে গেলে তিনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। এর এক পর্যায়ে তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যান। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারান অর্পিতা। জ্ঞান ফিরলেও অনবরত বমি করতে থাকায় ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়কসহ অন্যদের সহায়তায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় সাধারণ ও পলিটিক্যাল শিক্ষার্থীদের বের করে সেই কক্ষে তালা দিয়েছে কলেজ প্রশাসন। সোমবার দুপুরে ১১৪ জন লিগ্যাল (বৈধ) ছাত্রীর সই নিয়ে নুজহাত ফারিয়া রোকসানাকে কলেজ ও ছাত্রীনিবাস থেকে বহিষ্কার করতে কলেজ অধ্যক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের কাছে আবেদন জমা দেয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী বলেন, এমন ঘটনার কারণে মানসিকভাবে আমরা সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকি। ইতিপূর্বে আমরা কলেজ প্রশাসনকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকেও আমরা বিষয়টি অবহিত করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসব থেকে মুক্তি চাই।
এদিকে, অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত নুজহাত ফারিয়া রোকসানা। তিনি বলেন, এটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যারা মারধরের অভিযোগ করেছেন, তারা পারলে প্রমাণ দিক। ওই মেয়ে তো অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করেছে। তারা হলের সাধারণ শিক্ষার্থী। সাধারণ থাকবে, ঝামেলায় যেতে চাইবে কেন? তাছাড়া, তারা কীভাবে পলিটিক্যাল মেয়েদের বের হয়ে যেতে বলে। এত পাওয়ার তারা কোথায় পায়? তার মতে, লিগ্যাল মেয়েদের রুমে পলিটিক্যাল মেয়ে থাকলে অসুবিধা কী? সবাই তো ইডেনের ছাত্রী। তবে পলিটিক্যাল রুমে লিগ্যাল ছাত্রী রাখা যায় কি না এমন প্রশ্নে তিনি কোনো জবাব দেননি।
নুজহাত বলেন, এ ঘটনায় জবাব চেয়ে আমাকে হল থেকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। আমি দ্রুতই জবাব দেব। এ বিষয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের হল সুপার নাজমুন নাহারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, আসলে মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মেয়েটা একটু পড়ে গিয়েছিল। রোজা রাখছে তো! আমাদের মেয়েরা প্রায়ই এরকম অসুস্থ হয়ে যায়। শিক্ষকদের সঙ্গে নুজহাতের ধস্তাধস্তির কথা তুললে তিনি বলেন, না, এ রকম কিছু হয়নি (হাসি)। আপনার কথার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথার কোনো মিল নেই এমন কথায় তিনি বলেন, আমি এত কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। এরপর কল কেটে যায়। একটু পরে তিনি কল দিয়ে বলেন, ওর সঙ্গে হয়তো ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওকে মারধর করেছে খুব বেশি, তা নয়। মেয়েটি রোজা রাখায় অসুস্থ হয়ে গেছে। নুজহাত ফারিয়া রোকসানা তাহলে কিছুই করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে করেছে তো বটেই। সেজন্য ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেটা ওকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা ওকে হলে রাখতে ইন্টারেস্টেড না। রাখতে চাই না আর কি। তাকে হল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের সাধারণ মেয়েরা যাতে ভালো থাকতে পারে, সেজন্যই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ওই রুমে আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই থাকবে। কোনো পলিটিক্যাল মেয়ে থাকবে না। সাধারণ মেয়েরা চাইলে আমরা যেকোনো সময় ওই কক্ষের তালা খুলে দেব।