সরকারের অপরাধমূলক কর্মকান্ড আড়াল করতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার - মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১০ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০১:১৯ পিএম, ১২ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৫
সরকারের অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে আড়াল করতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কৌশল নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধানসহ সাতজন সরকারি কর্মকর্তার ভিসা বাতিল এবং প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই অভিযোগ আড়াল করার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লবিস্ট নিয়োগের তথ্য মার্কিন সরকারি ওয়েব পেজে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতকে উপলক্ষ করে সরকার তাদের সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে আড়াল করতে, জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে এবং দুঃশাসনকে প্রলম্বিত করতে বিএনপির বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচারের কৌশল নিয়েছে যে বিষয়ে আমরা আমাদের দলের অবস্থান আপনাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে দ্ব্যর্থহীনভাবে উপস্থাপন করছি। ওপরের পটভূমিকায় মূলত চারটি বিষয় আমরা উপস্থাপন করছি, যথাক্রমে, (১) বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন, (২) ভিসা বাতিল এবং নিষেধাজ্ঞা, (৩) সরকার এবং আওয়ামী লীগের লবিস্ট নিয়োগ এবং (৪) সত্যকে ধামাচাপা দিতে বিএনপির বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে সরকারের মিথ্যাচার করা!
তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশের জনগণসহ দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ গণতন্ত্রহীন, মানবাধিকারহীন, ন্যায় বিচারহীন একটি দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে যা আপনারা সবাই অবগত। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে যদি নির্বাচন ব্যবস্থাকে আইসিইউতে ঢুকানো বলে অবহিত করি, তাহলে এ কথা নিশ্চিত করে বলাই যায় যে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করে, রক্তের হোলি খেলায় মত্ত এই দানব কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার কবর রচনা করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার হরণের জন্য সরকারি বাহিনী ব্যবহার করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, রাজনৈতিক গায়েবি মামলার মত মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত এই সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি আজ সর্বজনবিদিত। ফলে, তাদের অপকর্মের জন্য যদি কারও ভিসা বাতিল হয় এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয় তা গোটা জাতির জন্য লজ্জাস্কর এক কলংকজনক অধ্যায় হলেও এই কানকাটা নির্লজ্জ সরকার এটাকে জাতীয় সংকট হিসাবে গণ্য না করে বেহায়ার মত তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্য, প্রত্যক্ষ-অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ হলে সরকার সর্ব প্রথমেই উক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যধারা শুরু করতো, গ্রেফতার করতো এবং জাতিকে কলংকের দাগ থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে জাতীয় সংকট হিসাবে সবার সহায়তায় এই পরিস্থিতির উত্তরণের চেষ্টা করতো। অথচ, কর্তৃত্ববাদী সরকার হাঁটছে উল্টো পথে, গুমের শিকার পরিবারের বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠিয়ে হুমকি ধামকি দিচ্ছে, খুনিদের রক্ষার সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার থেকে প্রমাণ হয় সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা এই সব খুন গুমের সাথে জড়িত। তাই বিএনপি অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ চায়, খুন, গুমের সাথে জড়িত নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সকলের নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, মানবাধিকার নিশ্চিত করা। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা চায়, গণতন্ত্র ফেরত চায়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাকে ধামাচাপা দিয়ে কর্তৃত্ববাদী অবৈধ সরকার জনগণের করের টাকায় আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগ করেছে যা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে স্বীকৃত। তার ভাষ্যমতে, সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে। খুন, গুমের মত অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তির দায় কিংবা ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতায় নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানের দায় রাষ্ট্র কিংবা সরকার কিভাবে জনগণের টাকায় ভাবমূর্তি রক্ষার নামে ব্যয় করে? বিএনপি মনে করে, জনগণের টাকায় লবিস্ট নিয়োগ করে সরকার মানবাধিকার লংঘনের মত গুরুতর অপরাধে নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়টিই প্রমাণিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপি মনে করে, সরকার জড়িত না থাকলে তা প্রমাণের জন্য তারা উক্ত সাত কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতো। খুন, গুম, গায়েবি মামলা দায়ের বন্ধ করে, নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে হেঁটে সরকার পদত্যাগ করতো। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের ৩ বছরে সজিব ওয়াজেদ জয়ের সংশ্লিষ্টতায় ৯০ লক্ষ (৯ মিলিয়ন) ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছিলো বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। যার প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্টের সরকারি ওয়েব পেজে আছে। বিএনপি জানতে চায়, সজিব ওয়াজেদ জয়ের ঐ টাকার উৎস কি ছিলো, কিভাবে ঐ টাকা বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় গিয়েছিলো?
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে কথা বলছেন সরকারের কয়েক জন মন্ত্রী। এই চিঠি দেখিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে। আপনারা দেখুন ঐ চিঠি কাকে লেখা হয়েছিল এবং চিঠির বিষয়বস্তু কি ছিল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি মানবাধিকার লংঘনের শিকার সকল ব্যক্তিবর্গদের সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ভ্যানগার্ড। আর তাই, বিএনপি তার আন্দোলন-সংগ্রামের অংশ হিসাবেই দেশের ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের সমর্থন চায়, মানবাধিকার লংঘন বন্ধ চায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামে দেশি-বিদেশি সব অংশীদারদের এই সরকরারের সকল অপকর্ম সম্পর্কে অবগত করে রাখতে চায়। বিদেশ লেখা আমার ঐ চিঠিসমূহ কোনো লবিস্ট নিয়োগের বিষয় নয়, মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি আহবান মাত্র! একজন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্তৃক লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টিও আজ আমাদের দলের ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে এই সরকার। আমরা বলতে চাই, দেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রবাসী কোনো পদক্ষেপ কোথাও নেয়, দেশের প্রতি তার ভালোবাসার জন্য যদি কিছু করে, সে পদক্ষেপের দায়িত্ব তার, বিএনপির নয়। ঐ পদক্ষেপকে নৈতিক সমর্থনের দায়িত্ব বাদে অন্য কোন দায় দায়িত্ব বিএনপি বহন করে না। তবে, বিশ্বের দেশে দেশে প্রবাসীদের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য এ ধরনের দেশপ্রেমিক পদক্ষেপকে বিএনপি সাধুবাদ জানায় এবং তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে।
গত সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, বাবু গয়েশ^র চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ :
১। সভায় বিগত ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পঠিত ও অনুমোদিত হয়।
২। সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সদস্যবৃন্দকে অবহিত করেন।
৩। সভায় ৭ কর্মকর্তা ও র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তথা সরকারের অসত্য ও বিকৃত বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে, নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্য অসত্য ও ভ্রান্ত বক্তব্য প্রকাশ করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এই বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
৪। সভায় হুদা নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকাল শেষ পর্যায়ে আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশনকে দায় মুক্তি প্রদানের তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করা হয়। বিএনপি মনে করে, দায় মুক্তি প্রদান করে বিগত ২০১২ ও ২০১৭ সালে বেআইনিভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অসাংবিধানিক এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বৈধতা প্রদানের হীন চক্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে ২০১৪ ও ২০১৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উক্ত দুই কমিশনের অযোগ্যতা, পক্ষপাতিত্বের কারণে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ এবং জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার গঠিত করা হয়। বেআইনিভাবে দুই বারই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসে নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের মাধ্যমে এই ধরনের ভোটারবিহীন অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। জনগণের নিকট এই প্রতারণা কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না।
৫। সভায় সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের জরিপে বাংলাদেশে ব্যবসার সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্নীতি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের সকল স্তরে দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলে স্বাধীনতার সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যার চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ায় দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের লাগামহীন দুর্নীতি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করছে। বিএনপি মনে করে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থাকে সচেতনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা হচ্ছে। শুধু ব্যবসা ক্ষেত্রে নয় কিছু দিন পূর্বে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দুর্নীতির সর্বোচ্চ স্থানে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপি মনে করে এই সরকারের পতনের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার নতুন অধ্যায়।
৬। সভায় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণে শিক্ষামন্ত্রী, তার আত্মীয়-স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে তার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
হবিগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র জিকে গাউসসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৪০ নেতা-কর্মীকে উচ্চ আদালতের আগাম জামিন সত্ত্বেও নিম্ন আদালত কর্তৃক কারাগারে প্রেরণের নিন্দা জানান মির্জা ফখরুল। গত ২২ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার দাবিতে হবিগঞ্জের সমাবেশে প্রধান অতিথি খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে পুলিশ হামলা চালায় এবং উল্টো বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।