রাত পোহালেই নাসিক নির্বাচন, নিরাপত্তাকে ঘিরে নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:১৬ পিএম, ১৫ জানুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:০৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
সারাদেশে নানা কারণে আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ রবিবার (১৬ জানুয়ারী)। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে এই কার্যক্রম। এতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন ভোটার। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর এটি তৃতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থীসহ সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১৮৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই এখন পর্যন্ত প্রচারণাসহ সকল কার্যক্রম চালিয়েছেন প্রার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকটাই সফল নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন। তবে ভোটের দিন বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলেও সাধারণ ভোটারদের প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশের। নির্বিঘেœ ভোট দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চান তারা।
এই নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও অ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকার। গত দুইবারের নির্বাচিত সিটি মেয়র আইভী এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। অন্যদিকে হাতি প্রতীকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন। ২০১১ সালে নাসিকের প্রথম নির্বাচনে ভোটগ্রহণের মাত্র ৫ ঘন্টা পূর্বে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন এই তৈমুর আলম খন্দকার।
নাসিকের তৃতীয় দফার নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। পুরুষ ভোটার রয়েছেন ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৬ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১১ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ৪ জন ভোটার রয়েছেন। ২০১৬ সালে নাসিকে মোট ভোটার ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। সে অনুযায়ী নতুন ভোটার ৪২ হাজার ৯৩০ জন। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৩৩ ভোটকক্ষে চলবে ভোটগ্রহণ। এ জন্য নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৯১২টি ইভিএম মেশিন আনা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রয়োজনের তুলনায় দেড়গুণ ইভিএম রাখা হবে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার। আজ শনিবার দুপুর থেকে কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো হয়।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯২টি কেন্দ্রের ৩০টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া ২৭টি ওয়ার্ডের ৮টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সার্বিক ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সবগুলো কেন্দ্রকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় রেখে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত।
প্রতিদ্বন্দ্বী ১৮৯ প্রার্থী
এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে পাঁচজন অংশগ্রহণ করেছেন। তারা হলেন: নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি মাসুম বিল্লাহ, দেয়ালঘড়ি প্রতীকে খেলাফত মজলিশের এ বি এম সিরাজুল মামুন, বটগাছ প্রতীকে খেলাফত আন্দোলনের জসিম উদ্দিন, হাতঘড়ি প্রতীকে কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস। বাকি দু’জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের মধ্যে বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া অ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকার লড়ছেন হাতি প্রতীকে। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম বাবু লড়ছেন ঘোড়া প্রতীকে। তাকে একদিনও প্রচারণায় দেখা যায়নি। এছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ৩৪ জন। কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। মোট ১৮৯ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজন মেয়র, ৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে সাধারণ কাউন্সিলর বেছে নেবেন ভোটাররা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন পরিচালনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ৯ জন। তারা হলেন: জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মতিয়ুর রহমান, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান, বন্দর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল কাদির, সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আফরোজা খাতুন, সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ইউসুফ উর রহমান, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের নির্বাচন কর্মকর্তা প্রতিভা বিশ্বাস, আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সুলতানা এলিন, কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ, ডেমরা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আল-আমিন।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনে ১৯২টি ভোটকেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ হাজারেরও বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। প্রতি কেন্দ্রে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৬ জন সদস্য। পুলিশের ২৭টি ইউনিট স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে। এছাড়া পুলিশের ৬৪টি মোবাইল টিম যার প্রতি টিমে একজন উপপরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে সদস্য থাকবেন পাঁচজন। নির্বাচনী মাঠে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) ৩টি স্ট্রাইকিং ফোর্স, চেকপোস্টে ৬টি, টহল টিমে ৭টি ও স্ট্যাটিক টিমে ২টি। এছাড়া এই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২০ প্ল্যাটুন সদস্য।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য ১৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পেনাল কোডের অধীনে তারা মামলা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারবেন। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে আগামী ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৫ দিন নির্বাচনী এলাকায় কাজ করবেন তারা। এছাড়া ২৭টি ওয়ার্ডে থাকবেন সাতাশজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন।
শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা শেষ হয়েছে। বহিরাগতদের নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে এলাকায় মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো যান্ত্রিক বাহন চলাচলও নিষিদ্ধ। এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় সকল ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নজর রাখবেন যারা
নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নয়টি সংস্থার ৪২ পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সংস্থাগুলো হলো: জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিক ফাউন্ডেশন, আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন, সমাজ উন্নয়ন প্রয়াস, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা, তালতলা যুব উন্নয়ন সংগঠন, রিহাফ ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন এবং মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা-মওসুস। এছাড়া সহশ্রাধিক গণমাধ্যমকর্মী এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ করবেন। কেবল নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে ৬ শতাধিক গণমাধ্যমকর্মী নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের কার্ড সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকা থেকেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা পর্যবেক্ষক কার্ড সংগ্রহ করেছেন।
৩২ ঘন্টায় তৈমুরের ৪ সংবাদ সম্মেলন
গত ১৪ জানুয়ারি দিবাগত রাত থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শেষ হয়। এদিকে গত ৩২ ঘন্টায় চারবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনেই তিনি একই অভিযোগ করেছেন। শুক্রবার সকাল ১০টায় নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাসদাইর এলাকায় নিজ বাসায় প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন তৈমুর আলম খন্দকার। ওই সময় তিনি তার ‘অনুসারী নেতা-কর্মীদের পুলিশ হয়রানি করছে’- বলে অভিযোগ করেন। এরপর শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা, শনিবার বেলা ১২টা এবং সন্ধ্যায় ৬টায় একই স্থানে পরপর তিনটি সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনেই একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেন স্বতন্ত্র এই প্রার্থী। তবে প্রশাসনের ভূমিকায় ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় আছেন বলে জানান তৈমুর।
স্বতন্ত্র এই প্রার্থী সকালে নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাসদাইরের ইসলামিয়া কামিল (এম এ) মাদরাসায় ভোট দেবেন বলে জানা গেছে। কেন্দ্রটি তার বাসার অদূরেই অবস্থিত।
সারাদিন বাসাতেই ছিলেন আইভী
শুক্রবার দুপুরে পথসভা ও বিকেলে বিশাল গণমিছিল শেষে সন্ধ্যায় দেওভোগে নিজ বাসায় যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। শনিবার (১৫ জানুয়ারী) সারাদিন তিনি বাসাতেই ছিলেন। তবে তার বাসায় নেতা-কর্মীদের আনাগোনা দেখা যায়। তবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণ হবে জানিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা বলেননি তিনি। জানা গেছে, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দেওভোগের শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেবেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী।
ফিরে দেখা দুই সিটি নির্বাচন
২০১১ সালের ৫ মে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, কদম রসুল পৌরসভা ও সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভাকে বিলুপ্ত করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠনের গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ওই বছরেরই ৩০ অক্টোবর নাসিকের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী (বর্তমান সাংসদ) শামীম ওসমানকে এক লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আইভী। দেশের প্রথম মেয়র হন আইভী। নির্দলীয় প্রতীকে ওই ভোটে মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন ছয়জন। সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫০ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন। ওইবার নারায়ণগঞ্জের ৯টি ওয়ার্ডে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেন ভোটাররা।
২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর নাসিকের দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নেন প্রার্থীরা। ওই নির্বাচনে প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। সেবার সব কেন্দ্রেই ব্যালটে ভোট হয়।