বন্ধ করে দেওয়া রেস্তোরাঁ খুলতে তোড়জোড়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৪ পিএম, ২৮ এপ্রিল,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:০৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
রাজধানীর বেইলি রোডে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আটতলা ভবনের প্রায় প্রতিতলাতেই ছিল নামিদামি রেস্তোরাঁ। নিয়ম না মেনে দেদার ব্যবসা চলছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীজুড়ে শুরু হয় অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁবিরোধী অভিযান। সরকারের পাঁচটি সংস্থা শুরু করে জরিমানা। কয়েকটি রেস্তোরাঁ সিলগালাও করা হয়। পুরোপুরি বন্ধ করা হয় দুয়েকটি ভবন। পুলিশ শত শত রেস্তোরাঁকর্মীকে আটক করে। ভয়ে রেস্তোরাঁ গুটিয়ে অনেকে পালিয়েও যান। দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া রেস্তোরাঁ আবার খুলতে শুরু হয়েছে তোড়জোড়।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া রেস্তোরাঁর মধ্যে বেশ কয়েকটি খুলেছে। গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি এখনও বন্ধ রয়েছে। তবে পাশের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি নতুন করে ব্যবহারের জন্য রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে একটি অতিরিক্ত ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি তৈরি করা হচ্ছে। শ্রমিকরা জানান, ভবনের মালিকরা এটি তৈরি করছেন। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ ছিল। অগ্নিকাণ্ডে সবকটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জানা যায়, কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডের পর টানা ১০ দিন বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালায়। ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সেই অভিযানে পুলিশ ১ হাজার ১৩২টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা প্রায় সবাই রেস্তোরাঁ কর্মচারী। অন্যদিকে রাজউক ৩৩ ভবনে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি ভবন ও দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করার পাশাপাশি সাত প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২২ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করে। ওই সময় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, রাজধানীর প্রায় ৪০ হাজার রেস্তোরাঁর মধ্যে সব ধরনের কাগজপত্র থাকা রেস্টুরেন্টের সংখ্যা মাত্র ১৩৪। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অনুমতি থাকা রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৫০০। বাকিগুলো ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। আবার কেউ কেউ একটি শাখার অনুমতি নিয়ে একাধিক শাখাও চালাত।
নামি বিরিয়ানি হাউস কাচ্চিভাইয়ের খিলগাঁও শাখাতেও অভিযান চালিয়েছিল রাজউক। তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখতে পেয়েছিলেন, সেখানে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী নেই। সিঁড়িতেও নানা জিনিসপত্র রাখা। তখন কিছু আর্থিক জরিমানা করে তিন মাসের মধ্যে শর্ত পূরণ করে রেস্তোরাঁ খোলার সুযোগ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সরেজমিন দেখা যায়, কাচ্চিভাই রেস্তোরাঁটি আবার চালু হয়েছে। রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা শর্ত পূরণ করে কয়েক দিন হলো রেস্তোরাঁ খুলেছি।
অবৈধ রেস্তোরাঁবিরোধী অভিযানে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ারের পুরোটাই সিলগালা করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৯ তলা ভবনটির প্রতিটি তলায় এক বা একাধিক রেস্তোরাঁ ছিল। গত মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটি খুলে দেওয়া হয়েছে। নিচতলার দোকানপাটও খোলা। বিভিন্ন তলার পাঁচটি রেস্তোরাঁও চালু হয়েছে।
ভবনটির সপ্তমতলা পার্ক এন স্মিক রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান জানান, ঈদের পরদিন থেকে তারা রেস্টুরেন্টটি খুলেছেন। যখন সিলগালা করা হয়, তখন তাদের ফায়ার এক্সিট সিঁড়িটি উন্মুক্ত রাখা এবং প্রতিতলা ও রেস্তোরাঁর ভেতরে ফায়ার স্টিংগুইশারসহ প্রয়োজনীয় ফায়ার ফাইটিং সামগ্রী নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। তারা সেসব শর্ত পালন করে রেস্তোরাঁ খুলেছেন।
একই ভবনের পাঁচতলায় থাকা রেস্টুরেন্ট ক্যাপিটাল লাউঞ্জের ব্যবস্থাপক হিমেল বলেন, ফায়ার এক্সিট সিঁড়িতে আগে প্রয়োজনীয় ফায়ার স্টিংগুইশার ও অ্যালার্ম ছিল না। এখন প্রতিটি ফ্লোরে ফায়ার অ্যালার্ম স্থাপন করা হয়েছে। ধূমপানমুক্ত করা হয়েছে পুরো ভবন। যেসব তলায় এসব নিশ্চিত করা হয়েছে, সেই তলাগুলো খোলা হয়েছে।
ভবনটির চতুর্থ তলায় থাকা বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্ট স্বদেশীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাত্র তিনজন ক্রেতা। প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের রেস্টুরেন্টটির বিভিন্ন স্থানে তারা বসে আছেন। রেস্তোরাঁকর্মীরা জানান, ঈদের পর খুললেও ক্রেতা তেমন আসছে না। খুলে রাখলে ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়বে। এ জন্য লোকসান দিয়ে হলেও খোলা রাখছেন।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডের পর দুই শতাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছু রেস্তোরাঁ মালিককে শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তারা সেসব শর্ত মেনে ধীরে ধীরে রেস্তোরাঁ খুলতে শুরু করেছেন। এখনও শতাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ।
তিনি বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন নিতে গেলে ডিসি অফিস বলে, আগে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন আনেন। সিটি করপোরেশনে গেলে বলে, আগে ডিসি অফিসের অনুমোদন নেন। এ সমন্বয়হীনতার কারণে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। অভিযানের পর সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে রেস্তোরাঁ ব্যবসার শর্তগুলো শিথিল করা হবে। সেই বৈঠক এখনও হয়নি। কোনো শর্তও শিথিল হয়নি।
রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) আবদুল আহাদ জানান, অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ হলেও গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির অবকাঠামো ঠিক আছে। কাজেই তারা ভবনটি ব্যবহার করতে চাইলে আপত্তি নেই। তবে রাজউকের নকশায় ভবনটির পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক, বাকিতলা আবাসিক। সেখানে রেস্তোরাঁ ব্যবসার কথা উল্লেখ নেই। নকশা অনুযায়ী ব্যবহার করলে কোনো সমস্যা নেই।