গুলশান-বাড্ডায় বিদেশি ফোনকল আতঙ্ক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৪৯ পিএম, ১৮ মার্চ,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:৪১ এএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বাড়ি করছেন, পোলাপান চালাইতে হবে, টাকা দেন; ব্যবসা করছেন, টাকা দেন; নতুন ফুডকোর্ট চালু করেছেন, দোকান দেন; বাড়ির কনস্ট্রাকশন শুরু করবেন, আমাদের কাছ থেকে রড-ইট-বালু-পাথর নেন। চাঁদা দাবি করে রাজধানীর গুলশান, ভাটারা, বাড্ডা এলাকার ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিকদের কাছে এমন কল আসছে হরহামেশাই। বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা পলাতক সন্ত্রাসীদের নাম করে এসব ফোনকল আসছে তাদের কাছে। আর যারা এসব ফোনে সাড়া দিচ্ছেন না, তাদের জন্য নেমে আসছে দুর্গতি। হামলা-গুলি করা হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। অস্ত্র দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগীরা। এই সহযোগীদের অধিকাংশই স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দলে রয়েছে তাদের পদ-পদবিও।
সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে চিহ্নিত কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী গুলশান-বাড্ডা এলাকায় ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এসব ঘটনায় ঘুরেফিরে জিসান, মেহেদী, রবিন, মানিকের নাম আসছে। তারা দেশের বাইরে পালিয়ে থাকলেও এই চাঁদাবাজির কাজে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীদের ব্যবহার করছে। সন্ত্রাসীদের এই তৎপরতার পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিবর্তন হওয়ার একটা প্রভাব রয়েছে।
একের পর এক চাঁদা চেয়ে ফোন, হুমকি এলেও ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। পুলিশের কাছে মৌখিক বা লিখিত কোনো ধরনের অভিযোগই করতে চান না তারা। তাদের ভাষ্য, যারা ফোনকল করে হুমকি দিতে পারছে, অফিসে গিয়ে গুলি করতে পারছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নতুন কোনো সমস্যায় পড়তে চাই না।
একের পর এক চাঁদা চেয়ে ফোন, হুমকি এলেও ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। পুলিশের কাছে মৌখিক বা লিখিত কোনো ধরনের অভিযোগই করতে চান না তারা। তাদের ভাষ্য, যারা ফোনকল করে হুমকি দিতে পারছে, অফিসে গিয়ে গুলি করতে পারছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নতুন কোনো সমস্যায় পড়তে চাই না।
তবে পুলিশ বলছে, সাধারণ মানুষের এই ভয়কে পুঁজি করেই সন্ত্রাসীরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, চাঁদাবাজি করে। এরই মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা দেশে থেকে এসব চাঁদাবাজি করছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রিফাত শামীম কালবেলাকে বলেন, সন্ত্রাসীরা ভয়কে পুঁজি করে চাঁদাবাজি চালায়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এরই মধ্যে অস্ত্রসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আরও যারা আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। আমাদের তদন্ত চলমান আছে।
ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভয় না পেয়ে যারা চাঁদা চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিদেশি নম্বর থেকে একের পর এক কল পাচ্ছিলেন বাড্ডার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী মতিউর রহমান সাগর। তিনি সাড়া না দেওয়ায় ৩ ফেব্রুয়ারি তার অফিসে ঢুকে গুলি করে গেছে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। তার মাথায় ছিল হেলমেট ও মুখে মাস্ক। সৌভাগ্যক্রমে কেউ হতাহত না হলেও আতঙ্কগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও কর্মচারীরা।
অফিসে গিয়ে গুলি চালানোর পরও মালয়েশিয়ার একটি নম্বর থেকে কল আসছিল সাগরের কাছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে একই নম্বর থেকে একটি ভয়েস মেসেজ পান সাগর। এতে বলা হয়, ‘মিজান সাহেব, (সাগরের ব্যবসায়িক পার্টনার) জিনিসটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাইতেছে, ফ্যামিলির ওপর এখনো অ্যাটাক-ফেটাক করি নাই। নেক্সট অ্যাটাক কিন্তু ফ্যামিলির ওপর হয়া যাবে। আপনার এই প্রশাসন বাঁচাবে না, প্রশাসন কারে ধরল, না ধরল নিরীহ পাবলিক ধইরাতো ক্রেডিট নিতাছে তাই না! কিছু যায় আসে না, সাফার কিন্তু আপনার করতে হবে। ভদ্রভাবে ফোনটা ধইরা কথা বলেন, তাহলে প্রবলেম সলভ হবে। ফোন না ধরলে কোনো প্রবলেম সলভ হবে না। কথা বললে বুঝা যাবে তারপর কী হবে। পারসোনাল কোনো শত্রুতা বানায়েন না, পারসোনাল শত্রুতা খুব খারাপ জিনিস। খোদা হাফেজ।’
সাগর জানান, মালয়েশিয়ার একটি নম্বর থেকে পলাতক সন্ত্রাসী রবিনের নাম করে তাকে কল ও ভয়েজ ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছিল। একই নম্বর থেকে তার অফিসে মেসেজ পাঠিয়ে বলেছে, ‘আপনাদের মালিক মিজান সাহেবকে বলবেন মালয়েশিয়া এই নম্বরে কন্টাক্ট করতে।’
সাগর দাবি করেন, সন্ত্রাসী রবিন ও তার অনুসারীরা চাঁদা আদায়ের জন্য ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে অফিসে গুলি করেছে, মেসেজ করছে। এসব কারণে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি বাড্ডা থানায় একটি মামলাও করেছেন তিনি। তবে তার অফিসে গিয়ে কে গুলি করেছিল, তা গত দুই সপ্তাহেও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম মেরুল বাড্ডা একটি ফুডকোর্টে ৩০ জনের বেশি সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ফুডকোর্ট ব্যবসায় রায়হানের কাছে ১০টি দোকান চেয়েছিল পলাতক সন্ত্রাসী মেহেদী কলিংসের অনুসারীরা। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করে। এতে বলা হয়, দুলাল, সজল, কালি সোহেল, সাইফুল, ইমরান, ময়লা সাঈদ, অর্ণব সাঈদ, রবিউল, পলক, বাঁধন, নজরুল, রুবেল, তুষার, রাজিব, মিনহাজ, ছোটনসহ ১০ থেকে ১২ জন এই হামলা চালায়। তারা মেহেদী কলিংসের অনুসারী। তারা বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নির্মাণাধীন ভবনসহ স্থাপনা তৈরির সময় মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি ও আদায় করে আসছে। তারা চাঁদাবাজির কৌশল হিসেবে নির্মাণাধীন ভবনের মালিকদের নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী জোরপূর্বক সরবরাহ করে বাজার মূল্যের তুলনার অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করে আসছে। আমেরিকায় পলাতক মেহেদীর নির্দেশে এসব কাজ করছে তারা।
এই দুই ঘটনার পর রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় চালানো ধারাবাহিক অভিযানে দুটি বিদেশি পিস্তল, ১৩ রাউন্ড গুলিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো আমজাদ হোসেন সোহেল ওরফে চাকু সোহেল, মহিউদ্দিন মহি ও জাহিদুল ইসলাম। ডিএমপি বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা কালবেলাকে বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ৯ রাউন্ড গুলিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে একটি বাসা থেকে আরও চার রাউন্ড গুলিসহ আরেকটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দস্যুতার চেষ্টার অভিযোগে ও অস্ত্র আইনে বাড্ডা থানায় দুটি মামলা হয়েছে।
থানা পুলিশ জানিয়েছে, তিনজন গ্রেপ্তার হলেও পলাতক আছে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী। তারা অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছিল। বিদেশে অবস্থানকারী জিসানের নাম ব্যবহার করছিল তারা।
গুলশান বিভাগের এক দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার কয়েকজনের কাছে পলাতক সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তার হয়েই ঢাকায় অস্ত্র প্রদর্শন ও চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর এই নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বাড্ডা-গুলশান এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নতুন করে নিতে চাচ্ছিল বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাশার। তার মধ্যস্থতায় জিসান দুবাই, মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে থেকে এক হয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। বাশার এখন পলাতক। আরও বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, যারা বিদেশে অবস্থানকারীদের হয়ে দেশে চাঁদাবাজি করে। পরে তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিবর্তন হওয়ার পর স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতবদল হয়েছে। আর সেটা জানান দেওয়ার জন্যই এমন গুলি, হামলার ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নির্বাচনে নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এতদিন যারা করছিল, এখন অন্যরা সেটা করতে চাচ্ছে। জিসান-মেহেদির হয়ে ঢাকায় কাজ করা বাদশার মতো ব্যক্তিরা নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য হামলা করছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নামটা ব্যবহার করে, এই নাম ব্যবহার ও ফোনকলে হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে পলাতক সন্ত্রাসীরাও এই চাঁদার ভাগ পেয়ে থাকে।
বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়ে বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম কালবেলাকে বলেন, যারা সন্ত্রাসী, তারা সন্ত্রাসীই। তাদের কোনো দল নেই। বিভিন্ন কৌশলে তারা অনুপ্রবেশ করে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জড়িতরা যে যে ইউনিট বা সংগঠনের তারা সেই ব্যবস্থা নেবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিবর্তনের প্রভাব কি না—জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জানুয়ারিতে। কার্যক্রম ভালোভাবে শুরুর আগেই এ ঘটনাগুলো ঘটেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ কেউ সংসদ সদস্যকে জড়ানোর চেষ্টা করছেন। দলে সন্ত্রাসীদের কোনো স্থান নেই।