৭২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অগ্নিপ্রবণ ঢাকায়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৩৩ পিএম, ৭ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৩:৪২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজে পৃথক দুটি আবাসিক ভবনে কলেজটির ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ক্লাস করে।
দুটি ভবনের একটি আট তলা এবং অন্যটি ছয় তলার। দুটি ভবনেই রয়েছে মাত্র পাঁচ ফুট প্রশস্ত সিঁড়ি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এই সিঁড়ি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স গতবছর তাদের সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কলেজের অধ্যক্ষ মাকসুদ উদ্দিন দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে কর্তৃপক্ষ তাদের সেটি জানায়নি।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। ছাদে একটি রিজার্ভ পানির ট্যাংকও আছে।
রাজধানীর যে ৭২০টি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্ভাব্য অগ্নিঝুঁকির জন্য 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এটি তার একটি।
ফায়ার সার্ভিস ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে ঢাকার ৮০১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ৬৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।
বাকি ১৬টি প্রতিষ্ঠানে সন্তোষজনক অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ওই সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে এক হাজার ৫২৭টি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে ৩৩৬টিকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' এবং এক হাজার ৭২টি 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে জানিয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে ভবনগুলোকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে, যেমন প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য সিঁড়ির সংখ্যা, সিঁড়ির প্রশস্ততা, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের সংখ্যা, ফায়ার হাইড্রেন্টের প্রাপ্যতা এবং জলাধারের সক্ষমতা।
বাংলাদেশ গর্ভনমেন্ট প্রেস হাইস্কুলকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রাজধানীর শিল্পাঞ্চল তেজগাঁওয়ে অবস্থিত এই বিদ্যালয়ের দুটি ভবন আছে, একটি তিনতলা এবং অন্যটি চারতলা।
প্রতিটি ভবনে স্কুলের প্রায় ১২০০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটি সিঁড়ি রয়েছে।
মঙ্গলবার স্কুলটিতে গিয়ে কোনো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, জরুরি বেরোনোর পথ, ফায়ার হাইড্রেন্ট দেখা যায়নি। যদিও স্কুলটি ২০১৭ সাল থেকে সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির জন্য 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসাবে তালিকাভুক্ত।
স্কুলটিকে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাভুক্ত করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমান আরা লাইজু।
'আমরা সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আগে জানলে আমরা ব্যবস্থা নিতাম।'
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্কুল পরিদর্শনের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয় আমাদের। তাই তাদের না জানানোর উপায় নেই।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দিনমনি শারমান বলেন, 'সব প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পরিদর্শনের সময় প্রধান শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার বর্ণনা দিই।
একাধিক সিঁড়ি, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের উপস্থিতি এবং অগ্নিনির্বাপক বালতির উপস্থিতির মতো সুরক্ষা ব্যবস্থা (যা নেওয়া দরকার) সে সম্পর্কে আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি।
২০১৮ সালে তেজগাঁওয়ের আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কেও 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রায় ২৫০০ জন নিয়মিত ক্লাস করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও বেশ কয়েকটিতে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের স্টিকার নেই।
ভবনের তদারককারী প্রকৌশলী আহসান হাবীব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ' হতে পারে স্টিকারগুলো সেখানে নেই, কিন্তু সব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রেরই মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ রয়েছে।
আগে সেন্ট্রাল ফায়ার সেফটি অ্যালার্মও ছিল না। আমরা ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কাছে একটি হালনাগাদ অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা জমা দিয়েছি। এটি অনুমোদন পেলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেব।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ' আমাদের নিজেদের অভিযান চালানোর এখতিয়ার নেই। আমরা রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে এটা করছি।'
'আমরা বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছি।'
ফায়ার সার্ভিস পাঁচ বছর আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, 'আমরা প্রায় ২০-২৫ বছর আগে স্কুল ও কলেজ ভবন হস্তান্তর করেছিলাম। সিঁড়ি, প্রবেশ এবং প্রস্থানের মতো অগ্নি সুরক্ষা বিষয়গুলি তালিকায় ছিল না বা আলোচিতও হয়নি।'
'তবে, নতুন স্কুল ভবন নির্মাণের সময় এসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগকে শিক্ষাগত অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পুরোনো ভবনগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'একটি ভবন হস্তান্তর করার পর সেটি রক্ষণাবেক্ষণের একমাত্র দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। তারা আমাদের সহায়তা চাইলে আমরা প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারি।'
দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, স্কুল-কলেজে অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে তারা রাজউককে অবহিত করেছেন। 'রাজউক এখন দেখবে ভবনটি সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন আছে কিনা বা রেট্রোফিটিং যথেষ্ট কিনা।'
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়া বলেন, রাজধানীর অধিকাংশ বিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।
তিনি বলেন, 'আমরা বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও চলমান স্কুলের কার্যক্রমের কথা বিবেচনা করে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জরুরি বহির্গমনের জন্য পৃথক স্টিলের সিঁড়ি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হবে।'