ঢাকার চার নদী রক্ষায় ঘোষিত ইসিএ ১৩ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪৫ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:১২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ঢাকা মহানগরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চারটি নদী; বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত এই চার নদীকে রক্ষায় ২০০৯ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলোজিকালি ক্রিটিকাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণার ১৩ বছর পার হলেও বাস্তবায়ন হয়নি ইসিএ। ২০১৮ সাল পর্যন্ত হাকালুকি হাওর ও কক্সবাজার জেলার কিছু জায়গায় ইসিএ বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীগুলোর ক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগই নেয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদফতরের এই ভূমিকাকে ‘রহস্যজনক’ বলে মনে করছে নদী রক্ষা কমিশন।
জানা গেছে, ইসিএ বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি পরিবেশ অধিদফতর। বিষয়টি নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিকবার বৈঠক ও চিঠি পাঠানো হয়েছে, এমনকি ফোন করে তাগাদাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রাজধানীর এই চার নদী এলাকায় ইসিএ বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ১৩ বছর ধরে ইসিএ বাস্তবায়নে কোনও উদ্যোগ নেই। আমাদের কাছে বিষয়টি খুবই রহস্যজনক লাগছে। খুবই অবাক হই যখন দেখি ইসিএ ঘোষণা করার পরও কোনও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর চুপ থাকে, তারা মুখই খুলছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসিএ ঘোষণার পর চার নদী এলাকায় সাইনবোর্ড লাগানোর কথা ছিল। প্রত্যেকটি পক্ষকে যুক্ত করে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠনের কথা ছিল। কিন্তু এসব উদ্যোগ নেয়নি অধিদফতর। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর দাবি, ‘কেবল চারটি নদীই নয়, বরং ঢাকার আশেপাশে আরও অনেকগুলো নদী আছে, উপরের দিকে বইছে, যেগুলোর অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল।’
তিনি উল্লেখ করেন, গাজীপুরের চিলাই নদী, লবণদহ এবং বংশী নদীও দূষণে আক্রান্ত। অনেক বিল, জলাভূমিও আছে দূষণের শিকারে বিপর্যন্ত। প্রতিবেশগতভাবে এসব নদী, জলাভূমিগুলোও দিনে-দিনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, এক্ষেত্রে মহামান্য আদালতের বিশেষ নির্দেশনা আছে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। ইসিএ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের অভিযোগ প্রসঙ্গে ড. আবদুল হামিদের ভাষ্য, ‘আমি এ বিষয়ে কোনও কমেন্ট করতে পারছি না।’
ইসিএ কী : পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, ভূপ্রাকৃতিক অনুকূল অবস্থার কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে দেশের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নানান ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন। ইতিমধ্যে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে। এর ফলে দেশের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কোনও কোনও প্রতিবেশের উৎপাদনশীলতাও কমে গিয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সর্বশেষ সংশোধিত ২০১০)’ অনুসারে বিভিন্ন সময়ে কিছু এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলোজিকালি ক্রিটিকাল এরিয়া বা ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পর্যন্ত দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীকে ইসিএ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইসিএ এলাকায় ৯টি কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কর্তন বা আহরণ; সকল প্রকার শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা; ঝিনুক, কোরাল, কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী ধরা বা সংগ্রহ; প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সকল প্রকার কার্যকলাপ এবং ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ।
এছাড়াও মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন; মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনও প্রকার কার্যাবলি; নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালীসৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্র্জ্য নির্গমন এবং কঠিন বর্জ্য অপসারণ এবং যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল বা অন্য কোনও পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যে কোনও খনিজসম্পদ আহরণও নিষিদ্ধ রয়েছে ইসিএ এলাকায়। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬’ ঘোষণা করে। প্রজ্ঞাপনে ইসিএভুক্ত এলাকায় ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটি, উপজেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি, গ্রাম সংরক্ষণ দল, জাতীয় কমিটি ও জেলা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। ইসিএভুক্ত এলাকাগুলোয় বিধিমালার কোনও বিধান লঙ্ঘন করলে দুই বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসিএ বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ অধিদফতরকেই উদ্যোগী হতে হবে। পুরো নদী এলাকার অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে ইসিএ বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালের ১৬ মার্চ তুরাগ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমে এ বছরের ১৭ মার্চের আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকার চারটি নদী দূষণ মুক্ত করতে সক্ষমতা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। এরপর জাতীয় রক্ষা কমিশন পরিবেশ অধিদফতর এবং ঢাকার দুই সিটির সঙ্গেও যোগাযোগ করে বিষয়টি অবহিত করে। কমিশনসূত্র জানায়, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও তুরাগ নদীকে দূষণমুক্ত করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর উল্লেখ করেন, সবগুলো নদীর পাড়ে যতো কারখানা আছে, সেগুলোতে ইটিপি (তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার) চালু করা, ঢাকা সিটির, বিশেষত, ঢাকা উত্তর সিটির দূষণ ১১টি খালে করে নদীগুলোতে পড়ছে, সেটা বন্ধ করা। তিনি বলেন, আমি সিটিকে লিনিয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আমরা হাল ছাড়িনি, আরও বলবো। চার নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগে দূষণরোধে ইসিএ বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে অনেকটাই নীরবতা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, মাননীয় হাইকোর্ট ঢাকার চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত চারটি নদীকে ইসিএ ঘোষণা করলেও সঠিক কোনও পরিকল্পনা না থাকার কারণে নদীর দখলও দূষণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পানি দূষণ রোধ করার জন্য সরকারের কোনও সঠিক পরিকল্পনা নেই।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বাপ্পি সরকার উল্লেখ করেন, পানি দূষণ রোধ করার জন্য বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি অবলম্বন করলে প্রায় ৮০ ভাগ বিশুদ্ধ পানি নদীতে ফেলা সম্ভব। বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি বলতে যে সকল নালা বা খাল দিয়ে পানি নদীতে গিয়ে পড়ছে তার মুখে মিনি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান স্থাপন করতে হবে। পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্যগুলো আলাদা করে পানি শোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে আলাদা একটি প্রকল্প গ্রহণ করে প্রকল্প এরিয়াতে সিসি ক্যামেরা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যার মাধ্যমে পানিশোধিত হয়ে নদীতে প্রবাহিত হবে। বাপ্পি সরদারের মত, নদীর চারপাশ দিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করতে সক্ষম হলে নদীকে দখলমুক্ত করা সম্ভব। নদীর নাব্যতা সংকট দূর করতে খনন কাজ জোরালো করার পাশাপাশি নদীর ব্যবহার বাড়াতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে নদীবন্দর ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। আধুনিক ঘাট নির্মাণ এবং নদীর পাড় জুড়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নৌ পুলিশকে নির্দেশনা দিতে হবে।