ছাদ-বাগান আর নির্মাণাধীন ভবন বাড়িয়েছে ডেঙ্গু!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৮ পিএম, ১১ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১০:১২ পিএম, ১২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
নির্মাণাধীন ভবন ও ছাদ-বাগান ডেঙ্গুর প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এডিস মশার লার্ভা যেসব স্থানে বেশি পাওয়া গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওই দুটি স্থান।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো হলো- ১, ১১, ১৪, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৯ নং ওয়ার্ড। জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এলাকাগুলো হলো- ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ৩৪, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২, ৪৮ ও ৫১ নং ওয়ার্ড।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের মশকনিধন কার্যক্রমে দায়িত্বে থাকা আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, সিটি কর্পোরেশনে মশকনিধন সংশ্লিষ্টরা ছুটির দিনসহ প্রতিদিনই নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ, ফগিং করা ছাড়াও মাইকিং করে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনার সময় আমরা দেখতে পাই নির্মাণাধীন যত ভবন আছে সেগুলোতেই মূলত এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছাদ-বাগান যারা নিয়মিত পরিচর্যা করছেন না, সেসব বাগানের স্বচ্ছ পানিতেও প্রচুর পরিমাণে লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এসব স্থানের বিষয়ে যদি সাধারণ মানুষ সচেতন না হন তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বলেন, অত্র এলাকার নির্মাণাধীন ভবন ও ছাদ-বাগানগুলোতে নিয়মিত অভিযান, পরিদর্শন ও ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম চলমান আছে। মূলত এ দুই স্থানে এডিসের লার্ভার প্রজননস্থল হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে প্রতিটি নির্মাণাধীন ভবন, প্রতিটি ছাদে গিয়ে বাগান পরিদর্শন এবং মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এজন্য সাধারণ মানুষের সচেতনতা জরুরি। এদিকে, ছাদ-বাগানগুলো এডিসের লার্ভার উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে এর ডাটাবেজ সংগ্রহে ড্রোন ব্যবহার করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসির এলাকায় ড্রোনের মাধ্যমে এক লাখ ২৮ হাজার বাড়ির ছাদ পরিদর্শন ও মনিটরিং করা হয়েছে। একইসঙ্গে মশার উৎপত্তিস্থলে ওষুধ ছেটানোর উদ্যোগও চলমান রয়েছে।
ড্রোন দিয়ে ডাটাবেজ সংগ্রহ না করলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন তাদের এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন ও ছাদ-বাগানগুলোতে নিয়মিত অভিযান ও পরিদর্শন কার্যক্রম চালু রেখেছে।
নিয়মিত অভিযানের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে ছাদ-বাগানগুলোর ডাটা আমরা ড্রোনের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছি। ছাদে গিয়ে কর্মীদের মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই কষ্টকর বিষয়। তাই ড্রোনের মাধ্যমে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন মশকনিধন কর্মীরা কেবল ওইসব বাড়িতে গিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, আমরা মশকনিধন কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করছি। যেসব ছাদ-বাগান বা নির্মাণাধীন ভবন মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোতে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানাও করছি। এছাড়া রিহ্যাবসহ ভবনমালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে নির্মাণাধীন ভবনে যেন পানি জমতে না পারে সে বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। সার্বিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, সঠিক সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারলে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান সম্ভব। সিটি কর্পোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এর টেকসই ও স্থায়ী সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ড ১০টি ব্লকে ভাগ করে ১০টি দল গঠনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। পুরস্কারের ব্যবস্থা করে কর্মীদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্বল্প সময়ের অভিযান বা কার্যক্রম চালিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা বছরব্যাপী কার্যক্রম চালাতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নির্মাণাধীন ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবে, ছাদ-বাগান থেকে যে খুব বেশি এডিসের লার্ভা উৎপত্তি হয়, সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবুও বাগানমালিকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত পরিচর্যার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের দাবি, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মশকনিধন কার্যক্রমে বেশ গতি এসেছে। মশকনিধন কর্মসূচি ও অভিযান আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের বিবরণী অনুযায়ী, প্রতি ওয়ার্ডে ১৩ জন করে কর্মী ও একজন সুপারভাইজার নিয়োগ করেছে তারা। মোট এক হাজার ৫০ কর্মী লার্ভিসাইডিং, অ্যাডাল্টিসাইডিং ও কীটনাশক প্রয়োগ এবং তা তদারকির কাজ করছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা ২২ কোটি ১২ টাকা করা হয়। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেও নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি মশক নিধনকর্মীরা ওষুধ ছেটানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সম্প্রতি কিউলেক্স মশার বেশকিছু হটস্পট শনাক্ত করে। তাদের ১০টি অঞ্চলে মশা নির্মূলে নিয়মিত কর্মী ৫৫০ জন। তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাজ করছেন। পাশাপাশি আরও কিছু অনিয়মিত কর্মীসহ সর্বমোট মশককর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার জন।