সড়কে সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, বেড়েই চলেছে খরচ : জনভোগান্তিরও শেষ নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৪ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৫৮ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। উন্নয়ন কাজের জন্য এলাকার বেশির ভাগ রাস্তায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। কোথাও মেট্রোরেল, কোথাও বিদ্যুৎ লাইন, স্যুয়ারেজ লাইন আবার কোথাও ওয়াসার পানির লাইন সংস্কারে চলছে এসব খোঁড়াখুঁড়ি। সমন্বয়হীনভাবে এসব সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে বাড়ছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও। পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। জনভোগান্তির যেন শেষ নেই! মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে রাজধানীর কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও এলাকায় মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এর মধ্যে যোগ হয়েছে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। আগারগাঁও এলাকায় সড়কের বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের কাজ। এ কাজের জন্য এলোমেলোভাবে সড়কেই ফেলে রাখা হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। এতে রাস্তা পারাপারসহ সার্বিক দিক থেকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এ এলাকার বাসিন্দাদের। তবে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের জন্য আগারগাঁও সড়কে দীর্ঘদিন ভোগান্তি পোহাতে হলেও মাঝে কিছুদিন কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন এ এলাকার মানুষ। তবে বর্তমানে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির আগে অনেকটা সময় নিয়ে সড়কটি মেরামত করা হয়। অথচ মেরামতের কিছুদিন না যেতেই কাটাকাটি করা হয়েছে। সমন্বয়হীনভাবে সড়ক কাটাকাটির ফলে মূলত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বছরের পর বছর বেড়েই চলছে বলে দাবি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। সওজ বলছে, বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে সড়ক মেরামতে।
সওজের তথ্যমতে, ১৯৬২ সালে তৎকালীন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং বিভক্ত হয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের সৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর বাংলাদেশের প্রধান সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় মোট ২২ হাজার ৪২৮ দশমিক ৪৫৪ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। মহাসড়ক নেটওয়ার্কের বিন্যাস অনুযায়ী ১০৮টি জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৯৮৯ দশমিক ২৪৮ কিলোমিটার, ১৪৮টি আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৮৯৭ দশমিক ৭০৮ কিলোমিটার, যার প্রশস্ত ৫ দশমিক ৫০ মিটার থেকে ৭ দশমিক ৩০ মিটার। ৭০৮টি জেলা মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ৫৪১ দশমিক ৪৯৮ কিলোমিটার, যার প্রশস্ত ৩ দশমিক ৭০ মিটার থেকে ৫ দশমিক ৫০ মিটার। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মহাসড়ক নেটওয়ার্কে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ও দৈর্ঘ্যর ৪ হাজার ২৮৭টি সেতু এবং ১৫ হাজার ৮৪টি কালভার্ট রয়েছে। মহাসড়ক যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে যুগোপযোগী এবং সময় সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে সদর দফতরের চারটি উইং, মাঠ পর্যায়ের ১০টি জোন, ২২টি সার্কেল, ৬৫টি বিভাগ এবং ১২৯টি উপ-বিভাগের মাধ্যমে উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া মেকানিক্যাল উইংয়ের মাধ্যমে ৪২টি ফেরিঘাটে সক্রিয় ১১৪টি ফেরির কার্যক্রম ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত কাজ তদারকির পাশাপাশি এসব কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও মেরামত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এবং টেকসই মহাসড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা। মহাসড়ক মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি নিরাপদ, ব্যয় সাশ্রয়ী, মানসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব মহাসড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। ২০২০-২১ অর্থবছরের রাজস্ব আয় ও ২০২০-২১ অর্থবছরে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ১০টি সড়ক জোনের আওতায় মোট ৮৬১ কোটি টাকা আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে।
এ অর্থবছরে সড়ক, সেতু মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছর থেকে ৮১৩ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। বরাদ্দ করা অর্থের বিপরীতে আয়ের শতকরা হার ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। নানা খাতে এ অর্থ খরচ হয়েছে। ১ হাজার ২১৬ কিলোমিটার মহাসড়কে ওভারলে, ২৪৪ কিলোমিটার মহাসড়কে ডাবল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট (ডিবিএসটি) করা হয়েছে। ৪২৯ কিলোমিটার সিঙ্গেল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট (বিএসটি), ৩০২ কিলোমিটার মহাসড়কে কার্পেটিং, ১ হাজার ২৫৫ কিলোমিটার মহাসড়কে সিলকোট, ২৬ কিলোমিটার মহাসড়কে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। ৮৬২ কিলোমিটার বিটুমিনাস সার্ফেসিং (ওভারলে), ৫৬ ডাবল বিটুমিনাস সার্ফেসিং ট্রিটমেন্ট (ডিবিএসটি), ২৭০ কিলোমিটার কার্পেটিংয়ের কাজ করা হয়। ৪৪ কিলোমিটার রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ, ১ হাজার ১৭০ কিলোমিটার মাইনর মেরামত, ২৭টি সেতু পুনর্নির্মাণ ও ১১৯টি কালভার্ট পুনর্নির্মাণ করা হয়। এ অর্থবছরে সড়ক, সেতু মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। বরাদ্দ করা অর্থ দিয়ে ১ হাজার ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ওভারলে, ১৮৯ কিলোমিটার ডিবিএসটি, ২৪৮ কিলোমিটার কার্পেটিং, ১ হাজার ৩৪৬ কিলোমিটার মাইনর মেরামত করা হয়। এছাড়া ৩৪ কিলোমিটার রিজিড পেভমেন্ট, ২৬টি সেতু পুনর্নির্মাণ ও ১১৮টি কালভার্ট পুনর্নির্মাণ করা হয়।
সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ব্যয় প্রসঙ্গে সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল) মো. জিকরুল হাসান বলেন, মূলত সমন্বয়হীনতার কারণেই প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামক খাতে ব্যয় হয়। আমাদের কিছু করারও থাকে না। অনেক সময় ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ ও টেলিফোনের লাইন কখন টানে আমরা জানি না। ফলে এসব সেবার সমন্বয় না থাকায় সড়ক মেরামত ব্যয় বেড়েই চলছে। আমাদের উচিত সবার মধ্যে একটা সমন্বয় করা, যাতে সড়ক মেরামত ব্যয় কমাতে পারি। তিনি বলেন, শুধু সওজের নয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতায় সড়কেও বেড়ে চলছে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। প্রতি বছর বাজেট ঘাটতি থাকে এ খাতে। ফলে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ চাওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বাজেটের ঘাটতি মেটাতে প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ চায় সরকার। সড়ক মেরামতে যে পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন এর ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ পূরণ হয়। ফলে প্রতি বছর সড়ক মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ গড়ে ৪০ শতাংশ বাজেট ঘাটতি থাকছে। এ ঘাটতি মেটাতেই বিশ্বব্যাংকের ঋণ চায় সরকার। ঢাকা-চট্টগ্রাম, গাজীপুর-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-ভাঙ্গাসহ কিছু মহাসড়ক চারর লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এসব সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বাজেট নেই। ফলে সড়কের বেহাল চিত্র প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। বাজেট ঘাটতির কারণে সড়কগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত অর্থবছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে মোট চাহিদার মাত্র ৬২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ফলে রুটিন ও বাৎসরিক সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কাজ সঠিকভাবে হয়নি, বাজেট ঘাটতি রয়ে গেছে। প্রতি বছরই বাজেটের অভাবে সড়ক মেরামতের কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে হচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ জানায়, দেশের মোট সড়ক মেরামতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪৫৮ কোটি ৬৫ লাখ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৬১২ কোটি ৮৬ লাখ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৭৯ কোটি ৭৫ লাখ এবং ২০২৫-২৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রয়োজন। ফলে আগামী চারটি অর্থবছরে সড়ক মেরামতের জন্য প্রায় ১০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা প্রয়োজন। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ‘রোড নেটওয়ার্ক মেইনটেন্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্য থেকে ২ হাজার ৫৯ কোটি টাকা বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ সহায়তা চায় সরকার। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য : মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সড়ক দুই লেন থেকে চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন সড়কগুলোর পিরিয়ডিক মেইনটেন্স এবং ব্যাকলগ মেইনটেন্সের জন্য বাজেট ঘাটতি নিরসনে অর্থায়ন করা এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়া সড়ক সেক্টরের পরিকল্পনা, নীতি প্রণয়ন এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালীকরণ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধিও এর উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম : ৯০০ কিলোমিটার সড়ক নির্বাচিত করে এগুলোর মানসম্মত রক্ষণাবেক্ষণ, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি এবং ক্রয়কার্যে সহায়তা দিতে পরামর্শক সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন কম্পোনেন্টের জন্য পরামর্শক সেবা, বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কার্য সম্পাদনের জন্য পরামর্শক সেবা নিয়োগ। বিভিন্ন কারণে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের এ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে বলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ জানিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মো. জাকির হোসেন বলেন, প্রতি বছর সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাজেটে ঘাটতি থাকে। সড়ক খারাপ হতে থাকলে তা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। এতে জনগণের ক্ষতি হয় টাকারও অপচয় হয়। সড়ক মেইনটেন্যান্স করা দরকার। কিন্তু পরিমাণ মতো বাজেট থাকে না। এজন্য বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা নেয়া হবে। সড়ক মেরামত ব্যয় কমানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েই চলছে। পাথর, বিটুমিন ও রডের দাম বেশি।