চলতি বছর রাজধানীতে বেড়েছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:২১ পিএম, ৬ জুলাই,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০১:২১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ঈদ এলেই রাজধানীতে বাড়ে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, চুরি-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। কোরবানির ঈদের আগে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এসব চক্র। কোরবানির পশু কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা তাদের টার্গেট। এসব চক্র ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। গত কয়েক মাসেও এসব চক্রের দাপটে আতঙ্কিত ছিল রাজধানীবাসী। দিন-রাতের যে কোনো সময়ই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন তারা। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে না। আর সাধারণ মানুষের পুলিশ রেকর্ড (জিডি/মামলা) না করার প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে অপরাধীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদুল আজহা সামনে রেখে দৌরাত্ম্য বেড়েছে মৌসুমি অপরাধীদেরও। কোরবানির পশুর হাটকেন্দ্রিক পেশাদার ছিনতাইকারী, চোর-ডাকাত, জালনোট চক্র এবং অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, শুধু রাজধানীতেই অন্তত ৫০টি গ্রুপের ছয় শতাধিক পেশাদার অপরাধী মৌসুমভিত্তিক অপরাধমূলক কাজ করছে। তারা এ ধরনের অপরাধ ঘটিয়েই ঢাকার বাইরে পালিয়ে যায়। এক গ্রুপ গা-ঢাকা দিলে আরেক গ্রুপ সক্রিয় হয়। এসব অপরাধী চক্রের হোতারা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হলেও স্বল্পসময়ে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই অপরাধ ঘটায়। তাই একেবারে রোধ করা যাচ্ছে না ভয়ঙ্কর এসব অপরাধ। ফলে এ পেশাদার অপরাধীদের ভয়ঙ্কর নির্মমতার শিকার হচ্ছেন পথেঘাটে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের শেষ ছয় মাসের চেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি বেশি হয়েছে। ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটে। এর বহুমুখী কারণ রয়েছে। তবে বড় কারণ দারিদ্র্য ও অপরাধপ্রবণতা। রয়েছে কিশোর অপরাধও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাজধানীতে প্রতি মাসে অন্তত ৩০টির বেশি বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। গত পাঁচ মাসে ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনায় ৮৯টি মামলা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, নারী নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাইসহ অন্যান্য কারণে দায়ের করা মামলায় মোট গ্রেফতার আসামি ২৩ হাজার ৭৩২ জন। জানুয়ারিতে গ্রেফতার আসামির সংখ্যা ৪ হাজার ৮৩৪, ফেব্রুয়ারিতে ৪ হাজার ৩৫৯, মার্চে ৫ হাজার ২২৯, এপ্রিলে ৪ হাজার ২২৭ ও মে মাসে ৫ হাজার ৮৩ জন।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা হয়েছে ১৪২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১১৬, মার্চে ১২৯, এপ্রিলে ১১০ ও মে মাসে ১৩০টি। পাঁচ মাসে এ ধরনের মোট মামলা ৬২৭টি। অন্যদিকে চলতি বছর ডিএমপির ৫০টি থানায় জানুয়ারিতে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১১৭টি। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১৪০, মার্চে ১৫৪, এপ্রিলে ১৫৯ ও মে মাসে ১৩৫টি। পাঁচ মাসে মোট ৭০৫টি, যা গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের চেয়ে ৭৮টি বেশি। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৭২টি অভিযানে ২৩১ ডাকাত গ্রেফতার করা হয়েছে। ছিনতাইকারী/মলমপার্টি/অজ্ঞানপার্টির বিরুদ্ধে ৪৯২টি অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে এক হাজার ৭৮ জনকে। গত ৭ জুন রাতভর রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ ও খিলগাঁও থানা এলাকায় রাতভর অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ মলমপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ ৪৪ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। এসময় তাদের কাছ থেকে অজ্ঞান ও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত মলম ও দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারের পর র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ঈদুল আজহা টার্গেট করে বিশেষত কোরবানির হাট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালের আশপাশের এলাকায় এ চক্রটি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিল। সাধারণত চক্রের সদস্যরা দিনে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালায়, গার্মেন্টসে চাকরি করে বা অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকে। সন্ধ্যা নামলেই এরা হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী, মলমপার্টি বা অজ্ঞানপার্টির সক্রিয় সদস্য। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন না। ফলে এ ধরনের চক্রের তৎপরতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। গত ১৬ জুন রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় আলাদা অভিযানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সাতজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, গ্রেফতাররা সালাম পার্টির সক্রিয় সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরের উত্তরা, মিরপুর, মতিঝিল এলাকায় কৌশলে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতো। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থান থাকতো ব্যাংকে। কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রিকশায় ফেরার পথে চক্রের সদস্যরা তাদের টার্গেট করে পিছু নিতো। রিকশাসহ ওই যাত্রী কোনো নির্জন রাস্তায় পৌঁছালে তাদের মধ্যে যে কোনো একজন টার্গেট করা রিকশার যাত্রীর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে রিকশার গতিরোধ করতো। এরপর তাদের সহযোগীরা একত্রিত হয়ে রিকশার হুড উঠিয়ে ওই যাত্রীকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নিতো নগদ টাকা, মোবাইল ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র।
গত ৩০ জুন রাতে রাজধানীর গুলিস্তানে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন আব্দুস সামাদ (৩৪) নামে এক পুলিশ সদস্য। জানা যায়, রাজধানীর শ্যামলী থেকে শুভযাত্রা পরিবহনে পুলিশ সদস্য আব্দুস সামাদ গুলিস্তান যান। বাসেই অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন তিনি। চক্রটি আব্দুস সামাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ও প্রায় ২০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।
ডিএমপির গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বেশকিছু ছিনতাইকারী ও ডাকাতচক্রকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা ডিএমপি কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধে আসন্ন কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছি। পাশাপাশি জেলা শহর থেকে পশুবাহী গাড়ি নির্বিঘেœ রাজধানীতে প্রবেশ ও চাঁদামুক্ত রাখতেও কাজ চলছে। এরই মধ্যে অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ জেল থেকে বেরিয়ে আবার অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ভাসমান মাদকাসক্তরা। যখন তাদের কাছে মাদক কেনার টাকা থাকে না তখনই তারা মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে ও পকেট থেকে টান মেরে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধে পুলিশের ক্রাইম বিভাগের পেট্রোল টিম ও ডিবির ছিনতাই প্রতিরোধ টিম রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করে। সেসব পয়েন্ট থেকে নিয়মিত এসব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ ধরনের চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই যেন না বাড়ে তার জন্য কমিশনার মহোদয়ের কঠোর নির্দেশনা আছে। র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মলমপার্টি-ছিনতাইচক্রকে গ্রেফতারে একাধিক সময় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে র্যাব। শুধু চলতি বছর এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মলমপার্টি-ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোরবানির ঈদ কেন্দ্র করে র্যাবের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। পশুবাহী ট্রাক থেকে যাতে কেউ চাঁদা তুলতে না পারে সেজন্য সারাদেশে মহাসড়কে পোশাকে ও সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছে র্যাবের সদস্যরা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি প্রধান) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, করোনার পর হঠাৎ করেই জনসমাগম বেড়েছে রাজধানীতে। বেড়েছে মানুষের চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এর সঙ্গে চুরি-ছিনতাইও বেড়ে গেছে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। বাসা-বাড়ি ও মার্কেটের আশপাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগালে ছিনতাই ও চুরির ঘটনা কমে আসবে। আমরা ডিএমপি থেকেও ব্যাপকভাবে সিসিটিভি লাগাচ্ছি। যখনই ঘটনা ঘটে তখনই নিকটস্থ থানা পুলিশ বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিন।