দয়াগঞ্জ ও রূপনগর
চার ঘণ্টা অপেক্ষা, তবু ফিরতে হলো খালি হাতে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ১৩ মার্চ,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৩৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে সকাল নয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ মোড়ে টিসিবির ট্রাকের সামনে নারীদের লাইনে এসে দাঁড়ান ষাটোর্ধ্ব হাসনা বেগম। ততক্ষণে তার সামনে পণ্য হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় অন্তত ৯০ জন। বেলা গড়িয়ে যখন একটা, তখনো ট্রাকের নাগাল পাননি হাসনা। এই সময়ে লাইনে থাকা নারীদের মধ্যে বলাবলি হচ্ছিল তেলের বোতল শেষ হয়ে গেছে। তবু হাসনা বেগম আশায় ছিলেন, ডাল-চিনি-পেঁয়াজ নিয়ে তো বাসায় ফিরতে পারবেন। তবে গতকাল শনিবার তপ্ত রোদে সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে তাকে। দয়াগঞ্জ মোড় থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে মিরপুরের রূপনগরের চিত্রও ছিল অনেকটা এমনই। এখানেও তেলের চাহিদা বেশি থাকায় তা আগেই শেষ হয়ে যায়। এই এলাকার ‘ট’ ব্লক বস্তির পাশে টিসিবির ট্রাকের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অন্তত ৮৩ জন নারী ও পুরুষ কাক্সিক্ষত পণ্য নিয়ে ঘরে যেতে পারেননি।
টিসিবি পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় প্রতিনিয়ত মানুষের চাপ বাড়ছে। তবে চাহিদা বেশি ভোজ্যতেলের। একটি ট্রাকে দুই থেকে আড়াই শ জনের জন্য পণ্য থাকে। কিন্তু মানুষ আসেন চার-পাঁচ শ। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। দয়াগঞ্জ মোড়ে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ জন নারী-পুরুষকে। তাদের কেউ কেউ সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কোনো পণ্য পাননি।
দয়াগঞ্জ মোড়ে বেলা পৌনে দুইটার দিকে আবার কথা হয় হাসনা বেগমের সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, হঠাৎ সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তুলনামূলক কম দামে পণ্য কিনতে এসেছিলেন। কিন্তু কপালে কিছুই জুটল না। দয়াগঞ্জ মোড়ে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ জন নারী-পুরুষকে। তাদের কেউ কেউ সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কোনো পণ্য পাননি।
একজন ব্যক্তি টিসিবির ট্রাক থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ডাল ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারেন। আর প্রতিটি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকে ৫০০ লিটার তেল, ১ হাজার কেজি পেঁয়াজ এবং ৫০০ কেজি করে চিনি ও মসুর ডাল। দয়াগঞ্জ মোড়ে এই প্রতিবেদক সাড়ে চার ঘণ্টা ছিলেন। পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার কারণেও ক্রেতাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কে কার আগে পণ্য নেবেন, তা নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হট্টগোল লেগেই ছিল। পণ্য সরবরাহের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, তেলের দাম বাড়ার পর থেকে মানুষের লাইন বাড়ছে। এখন লাইনে মারামারিও হচ্ছে। মাঝেমধ্যে সামাল দেয়া যায় না।
এদিকে মিরপুরের সেকশন-৬-এর রূপনগর এলাকায় টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক গতকাল যেখানে অবস্থান করছিল, তার পাশেই ছিল বস্তি। এখানে মূলত বস্তির বাসিন্দারাই এসব পণ্যের ক্রেতা। তবে নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেকে এখন ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। গতকাল লাইনে থাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী বললেন, তিনি যে টাকা বেতন পান, তাতে সংসার চলছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। পণ্য কিনতে বেলা সোয়া দুইটার দিকে এসেছিলেন গৃহিণী আসমা বেগম। তখনো নারীদের সারিতে পণ্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় ৭০ জন। এ সময় লাইনে থাকা অন্য নারীরা আসমাকে বলেন, আইজকা আর লাভ নাই। আমরাই পাইমু কিন্যা ঠিক নাই।
রাস্তায় কেনে পুলিশ, লাইন ছাড়াই নেন কাউন্সিলরের লোক : টিসিবির তেজগাঁওয়ের গুদাম থেকে পণ্য নিয়ে সরাসরি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের নির্ধারিত স্থানে চলে আসার কথা ছিল ট্রাকটির। কিন্তু পথে বিজয় সরণি মোড়ে পুলিশ ট্রাক থামিয়ে চার বোতল (আট লিটার) সয়াবিন তেল বিক্রি করতে বাধ্য করে টিসিবির পরিবেশকের কর্মীদের। এরপর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রি শুরুর পর এক কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে পরিবেশকের কাছে ফোন আসে। এর কিছুক্ষণ পর তিনজন লোক এসে লাইনে না দাঁড়িয়েই ছয় লিটার তেল কিনে নিয়ে যান। এসব অভিযোগ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার পরিবেশক মেসার্স লোপা ট্রেডার্সের মালিক আবু সাঈদের। গতকাল শনিবার বিকেলে তিনি বলেন, শুধু আমার ট্রাক না, বিজয় সরণি মোড় হয়ে আজকে যত ডিলারের ট্রাক গেছে, সব ট্রাক থেকে তেল রেখে দিয়েছে পুলিশ।
আবু সাঈদ বলেন, পুলিশ টাকা দিয়ে তেল কিনলেও এভাবে রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে বিক্রি করার নিয়ম নেই। যে কারণে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তেল কিনতে পারে না সবাই।
তিনি বলেন, কাউন্সিলরের লোক, অমুকের লোক এ রকম পরিচয় দিলে তাদের বাধা দেয়া যায় না, পণ্য বিক্রি করতেই হয়। অবশ্য কোন কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে ফোন এসেছিল, তা বলতে চাননি তিনি। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গতকাল টিসিবির ট্রাকের সামনে সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পরও ১৬ জন ক্রেতা সয়াবিন তেল কিনতে পারেননি। পরে তারা দুই কেজি করে মসুর ডাল ও চিনি কিনেই বাসায় ফিরেছেন। আর লাইনে দাঁড়ানো আরও ৬৫ জন কোনো পণ্যই কিনতে পারেননি। তাদের মধ্যে নারী ৩৯ জন ও পুরুষ ২৬ জন। শুধু আমার ট্রাক না, বিজয় সরণি মোড় হয়ে আজকে (গতকাল) যত ডিলারের ট্রাক গেছে, সব ট্রাক থেকে তেল রেখে দিয়েছে পুলিশ।
দুপুর ১২টার দিকে টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইনে এসে দাঁড়ান রোশনারা বেগম নামের এক নারী। চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তার সামনে যখন আরও সাতজন, তখনই পণ্য বিক্রি শেষ হয়ে যায়। ট্রাক চলে যাওয়ার সময়ও পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। ট্রাকে থাকা টিসিবির পরিবেশকের এক বিক্রয় প্রতিনিধিকে অনুরোধ করে বলছিলেন, যা আছে তাই যেন তার কাছে বিক্রি করা হয়। তবে তাকে দেয়ার মতো কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। রোশনারা বেগম মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি বছিলায় বস্তিঘরে থাকেন। আজ কিছু কিনতে না পেরে কাঁদছিলেন তিনি। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আজ টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয় বেলা ১১টার দিকে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ট্রাকে শুধু মসুর ডাল ও চিনি ছিল। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি করে মসুর ডাল ও চিনি, পাঁচ কেজি পেঁয়াজ ও দুই লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল কিনতে পারেন। বিক্রির সুবিধার্থে পরিবেশকেরা পণ্যগুলো একত্রে একটি ‘প্যাকেজ’ করে ৬১০ টাকায় বিক্রি করেন। এসব পণ্য এখন বাজার থেকে কিনলে একজন ক্রেতার খরচ হবে ১ হাজার ৪৫ টাকা। অর্থাৎ সাশ্রয় হয় ৪৩৫ টাকা। বাজারে এখন এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা, মসুর ডালের কেজি (মোটা দানা) ১০০ টাকা, চিনির কেজি ৮০ টাকা আর এক লিটার বোতলজাত তেলের দাম ১৭০ টাকা। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সাধারণত টিসিবির ট্রাক আসে বেলা ১১টার পর। গতকাল সকাল ১০টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট দলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিংবা ফুটপাতে বসে শতাধিক নারী ও পুরুষ অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন বলেছেন, তারা সকাল ৮টার দিকে এসেছেন। এত আগে আসার কারণ কী, জানতে চাইলে তারা বলেন, কখনো কখনো নয়টার মধ্যে ট্রাক চলে আসে। আর আগে এলে আগে লাইনে দাঁড়ানো যায়। বেলা ১১টার দিকে সেখানে টিসিবির ট্রাক পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। লাইনে কে কার আগে দাঁড়াবেন, এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষায় থেকেও যারা পণ্য পাননি, তাদের একজন গৃহিণী মনি আক্তার। তার স্বামী নওরোজ আহমেদ নিউমার্কেটের একটি দোকানের বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। তারা থাকেন মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায়। মনি আক্তার মেয়েকে স্কুল থেকে দুপুর ১২টার দিকে বাসায় রেখেই লাইনে এসে দাঁড়ান। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সময় গেল, পরিশ্রম হলো কিন্তু কিছু পেলাম না।