ঢাকায় বায়ুদূষণরোধে বাপার ১৫ সুপারিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৪ পিএম, ২৭ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৫ পিএম, ৮ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
রাজধানীতে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে বায়ুদূষণ। ঢাকায় বায়ুদূষণরোধে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ১৫টি সুপারিশ তুলে ধরেছে।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘বিপজ্জনক মাত্রায় ঢাকার বায়ুদূষণ : জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালে ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল তেজগাঁও এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম)। এর পরের অবস্থানে ছিল শাহবাগ এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)। এছাড়া ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
স্ট্যামফোর্ড বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ২ শতাংশ (৩৮ দিন) সময় ভালো বায়ু গ্রহণ করে। আর ২৬ শতাংশ (৫১০ দিন) চলনসই মানের বায়ু, ২৯ শতাংশ (৫৭৭ দিন) সংবেদনশীল বায়ু, ২২ শতাংশ (৪৪৩ দিন) অস্বাস্থ্যকর, ১৯ শতাংশ (৩৮৫ দিন) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ২ শতাংশ (৩৭ দিন) সময় দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করে।
ঢাকা শহরের ১০টি স্থানে চালানো গবেষণার তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, প্রতিটি স্থানের গড় বস্তুকণা নির্ধারিত মানমাত্রার কয়েক গুণ বেশি ছিল। গবেষণা অনুযায়ী, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি ৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এই এলাকাগুলোতে গড় বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১, ৬৬ এবং ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ছিল, যা নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাপসার পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
তিনি বলেন, গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার মানুষের এক দিনের জন্যও ভালো বায়ু সেবন করার সৌভাগ্য হয়নি। বায়ুমান বেশির ভাগ সময় ‘অস্বাস্থ্যকর’ থেকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিল। ঢাকা শহরে বিকেল ৪টার পর থেকে বায়ুদূষণের মান খারাপ হতে শুরু করে এবং তা রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। গত ছয় বছরে গড় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাত ১টার সময় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬২, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রচুর মালবাহী ট্রাক ঢাকা শহরে প্রবেশ করে, যার কারণে এসব যানবাহন থেকে রাতে প্রচুর বায়ুদূষণ হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো রাতের বেলায় সিটি করপোরেশন কর্তৃক ঝাড়ু দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে,, যার কারণে বাতাসে ধুলাবালি উড়তে থাকে। রাতের বেলায় যেহেতু দিনের চেয়ে তাপমাত্রা কম থাকে, সেহেতু ধুলাবালি বাতাসে বেশি সময় ধরে অবস্থান করে বলে তিনি মনে করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ঢাকা নগরের বায়ুর মান ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে হতে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে নাগরিকদের অবগত না করায় সরকারের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আন্তরিকতা আছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি অবিলম্বে ঢাকা শহরের বায়ু সম্পর্কে যথাযথ তথ্য যথাসময়ে সাধারণ মানুষকে অবগত করার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় একটি মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে এবং আমরা সেই উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়ন জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫টি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ :
১. শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২. নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।
৩. রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।
৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ : ৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. ঢাকার আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
৮. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে স্যান্ড ব্লকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
১০. সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়ন মূলক কার্যকলাপের সমন্বয় করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকা- স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ : ১১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়া বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।
১৩. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
১৪. ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বাপার নির্বাহী কমিটির সদস্য এম এস সিদ্দিকী, ইবনুল সাঈদ রানা, ক্যাপসের গবেষণা শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম এবং যুব বাপার সদস্য সচিব রাওমান স্মিতা প্রমুখ।