সরকারের মতো করে নির্বাচন করার জন্যই আইন করা হচ্ছে : সুজন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫০ পিএম, ২৩ জানুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০১ এএম, ১৩ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সরকারের মতো করে নির্বাচন করার জন্যই আলোচনা না করে এই আইন করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সরকার প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ আইন নিয়ে সুজনের সংবাদ সম্মেলনে বক্তরা এসব কথা বলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
আজ রবিবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান-এর সভাপতিত্বে এবং সুজন সস্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন।
এছাড়া সুজন-এর নির্বাহী সদস্যগণের মধ্যে বিচারপতি মোঃ আবদুল মতিন, অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি প্রফেসর সিকান্দর খান, সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, রাজশাহী জেলা সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, অনুমোদিত খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খসড়া আইনটির সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য নেই বললেই চলে। কত সদস্যের কমিটি গঠিত হবে, কমিটির সদস্য কারা হবেন, কমিটির ওপর অর্পিত দায়িত্ব, কমিটির কার্যদিবস, কমিটির কোরাম গঠন, প্রতি পদের বিপরীতে সুপারিশকৃত নামের সংখ্যা, সাচিবিক সহায়তা।
এই বিষয়গুলো প্রস্তাবিত খসড়া এবং ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে অভিন্ন। কমিটির কার্যাবলির ক্ষেত্রে নাম আহ্বানের বিষয়টি যোগ হয়েছে এবং অন্যদিকে ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে নাম সুপারিশের ক্ষেত্রে ন্যূনতম একজন নারী রাখার বিষয়টি থাকলেও খসড়া থেকে এটি বাদ দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপন এবং মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়ার তুলনামুলক বিশ্লেষণ থেকে এটি পরিষ্কার যে, এটা ঠিক নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন নয়, অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আইন। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনাকে আইনী মোড়ক দেওয়াই যেন এর উদ্দেশ্য।
প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিশনারগণের যোগ্যতা-অযোগ্যতার যে মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে তা সবই দালিলিক প্রমাণের বিষয়। কেউ বাংলাদেশের নাগরিক কি না, বয়স ৫০ বছর হয়েছে কি না, ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে কি না, কিংবা খসড়ায় উল্লেখিত অযোগ্যতার আওতায় পড়েন কি না। তা কিছু দালিলিক কাগজপত্র পরীক্ষার করলেই যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু একজন ব্যক্তি খসড়ায় উল্লেখিত যোগ্যতার-অযোগ্যতার মাপকাঠিতে উতরে যাওয়ার পরও কমিশনার হওয়ার জন্য তিনি কী কী বিশেষ যোগ্যতা বা গুণের অধিকারী। এটাই মূল বিচার্য বিষয়।
এখানেই যত তর্ক-বিতর্ক। এ তর্ক-বিতর্ককে যথাযম্ভব কমিয়ে এনে সবার জন্য কল্যাণকর একটা সর্বজনীন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যই কমিটির কার্যাবলিকে স্বচ্ছ রাখাসহ যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারের খসড়ার সঙ্গে সুজন প্রস্তাবিত খসড়ার বড় পার্থক্য হলো। সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিটির কার্যাবলির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য নামের তালিকা প্রকাশ এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য গণশুনানির বিধান রাখা হয়েছে। কমিটির নাম যাচাই প্রক্রিয়াকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ করার লক্ষ্যে দুই ধাপে নামের তালিকা প্রকাশের বিধান রাখা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা এবং ৭ জনের চূড়ান্ত তালিকা। শুধু তা-ই নয় সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় যাচাই প্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে কমিটির সভার পূর্ণাঙ্গ কার্যবিবরণী এবং সদস্যদের ভোট প্রদানের তথ্য লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণের বিধান।
কোনো নাগরিক যদি কমিটির সভার কার্যবিরণীর অনুলিপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেন, তবে অনতিবিলম্বে প্রদান করার বিধান রাখা হয়েছে, যাতে নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়। এছাড়া নারী কমিশনার নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক তালিকায় ন্যূনতম ৫ জন এবং চূড়ান্ত তালিকায় ন্যূনতম ২ জন নারী রাখার প্রস্তাব করেছে সুজন; দুঃখজনকভাবে সরকারের প্রস্তাবনায় কমিশনে নারী কমিশনার রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। বলাবাহুল্য, সুজন প্রস্তাবিত কার্যাবলি স¤পাদন সময়সাপেক্ষ; এজন্য খসড়ায় কমিটির কার্য স¤পাদনের জন্য ১-২ মাস সময় রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকারের খসড়ায় সময় রাখা হয়েছে মাত্র দশ কার্যদিবস, এত স্বল্প সময়ে কমিটি কীভাবে অনুসন্ধান ও যাচাই প্রক্রিয়া স¤পাদন করবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। সরকার প্রস্তাবিত খসড়াতে অনুসন্ধান কার্যক্রম রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহবানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন গুরুত্বপূর্ণ। কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলেও বিতর্কিত নির্বাচন ঠেকাতে পারে। নির্বাচনে বিতর্কের সম্ভাবনা দেখা দিলে নির্বাচন স্থগিত করতে পারে, এমনকি তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফলও বাতিল করতে পারে। সরকারের আইনে বলা হয়েছে কমিটি পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দল থেকে আহ্বান করবে। নাম আহ্বান করাই কি অনুসন্ধান? আবার যে সব যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারিত করা হয়েছে তার আলোকে হাজার হাজার ব্যক্তিকে বিবেচনায় রাখা সম্ভব, যে কাউকে নিয়োগ দিলেই হলো। কাদের নাম বিবেচনায় আছে আমরা কিছুই জানব না। দুই মাস আগে আইনমন্ত্রীর কাছে আমাদের খসড়ার কপি দিলে গেলে উনি সময় নেই বললেন। এখন কারো সাথে আলোচনা না করেই আইন পাসের জন্য তড়িঘড়ি করছেন। তাদের মতো করে নির্বাচন করার জন্যই আলোচনা না করে এই আইন করা হচ্ছে।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ২০০২ সাল থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আসীন হয়েছেন তারা সরকারের প্রতি কোনো না কোনোভাবে সহানুভূতিশীল। তাদের দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করা হলে তারা কী সার্চ করবেন? আর দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবেন। স্বীয় বিবেচনায় কাউকে মনোনীত করার ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দেয় নাই। বোঝাই যাচ্ছে মনোনয়ন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই আসবে। এটি হবে একটি পক্ষপাতদুষ্ট সার্চ কমিটি। তারা যে নামগুলো প্রস্তাব করবে তা জানার সুযোগ থাকছে না। সরকার নির্ধারিত সার্চ কমিট দিয়ে সরকার নির্ধারিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠিত হবে। এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কর্তৃত্ববাদীরা এমনভাবে নির্বাচন করে যাতে তারা জয়ী হয়। এতদিন আমরা আইন করার কথা বলতাম, এখন আইন করে দিচ্ছে। আমাদের সাথে লুকোচুরি করার জন্যই এই আইন করা হচ্ছে, লুকোচুরি করা তো আইনের উদ্দেশ্য হতে পারে না।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই আইনের ফলে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের ওপর কি কোনো প্রভাব ফেলবে? আমরা কমিশনে থাকাকালীন যে খসড়াটি প্রস্তাব করেছিলাম সেখানে বলা ছিল সুপারিশকৃত নামগুলো প্রথমে সংসদের বিশেষ কমিটিতে যাবে, সেখানে আলোচনা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। এই কমিটিতে সব দলের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ থাকে। তাহলে প্রধামন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কম থাকে। বিচারপতি মোঃ আবদুল মতিন বলেন, আইনটি যে গুড মোটিভ নিয়ে করা হচ্ছে এরকম কোনো নজির দেখছি না। রাখঢাক করে আইন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আগের মতোই ইলেকশন করা।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সার্চ কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার জন্যই আইন করতে হবে। সেটা না হলে এরকম আইন এখনই পরিত্যাজ্য। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ হলে সংবিধানের ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য করাই সংবিধানের মূল স্পিরিট।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বার বার শুনে আসছি আইন করার সময় নেই, এখন করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপেও রাষ্ট্রপতি বলেছেন সময় নেই। এরপর হঠাৎ কী পবতন হয়ে গেল! মন্ত্রিসভায় খসড়া অনুমোদন হয়ে গেল! এখন আদালতে যাওয়ার নাগরিক অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে।