মাফিয়া কুইন ‘গাঙ্গুবাঈ' এ শুধু আলিয়ার ছবি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:৩০ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:০১ এএম, ১২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অবশেষে গত শুক্রবার মুক্তি পেল সঞ্জয় লীলা বানসালির বহু অপেক্ষিত ছবি ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’। এ ছবিতে মাফিয়া কুইন ‘গাঙ্গুবাঈ’–এর চরিত্রে দেখা গেছে বলিউড অভিনেত্রী আলিয়া ভাটকে। ‘গাঙ্গুবাঈ’–এর মতো এক দাপুটে চরিত্রের সঙ্গে আলিয়া কতটা ন্যায় করতে পারবেন, তা নিয়ে ছিল একরাশ সংশয়। কারণ গাঙ্গুবাঈ আর আলিয়ার ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। আর গাঙ্গুবাঈয়ের মতো প্রভাবশালী চরিত্রের জন্য একজন অভিনয়শিল্পীর যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, আলিয়ার তা নেহাতই কম। তাই শুরুতে বানসালির কাস্টিং নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবির ট্রেলার মুক্তির পর আলিয়া অনেক সমালোচকের মুখ বন্ধ করেছিলেন। ছবির প্রতিটি দৃশ্যে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বানসালির দূরদৃষ্টি কতটা সঠিক ছিল।’
হুসেন জাইদির লেখা ‘মাফিয়া কুইন্স অফ মুম্বাই’ বইয়ের আদলে নির্মিত বানসালির ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবিটি। এ ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে ১৪ বছরের এক মেয়ের গঙ্গা থেকে গাঙ্গুবাঈ হয়ে ওঠার সংঘর্ষময় এক কাহিনি। ১৪ বছরের গঙ্গার দুই চোখজুড়ে ছিল মায়ানগরী মুম্বাইয়ের হাতছানি। রুপালি পর্দার নায়িকা হতে চেয়েছিলেন ১৪ বছরের গঙ্গা। কিন্তু পরে তাঁর জীবনযুদ্ধই হয়ে ওঠে এক ছবির কাহিনি।
গঙ্গার নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর প্রেমিক। প্রেমিকের হাত ধরে নিজের পরিবারকে ছেড়ে গঙ্গা চলে এসেছিলেন মুম্বাইতে। কিন্তু গঙ্গা যাঁকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলেন, সেই প্রেমিক তাঁকে ধোঁকা দেন। হাজার টাকার বিনিময়ে মুম্বাইয়ের অখ্যাত গলিতে তাঁকে বিক্রি করে দেন।
গঙ্গার নতুন ঠিকানা হয় কামাতিপুরার যৌনপল্লি। অচিরে তিনি হয়ে ওঠেন গঙ্গা থেকে গাঙ্গুবাঈ। ছবির কাহিনি এ পর্যন্ত খুবই চেনা। গঙ্গার মতো হাজারো মেয়ের আর্তনাদের নীরব সাক্ষী অন্ধকার গলির স্যাঁতসেঁতে দেয়ালগুলো। কিন্তু গাঙ্গুবাঈ আর পাঁচটা যৌনকর্মীর মতো মুখ বুজে সব যন্ত্রণা সহ্য করেননি। রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের (যৌনকর্মীদের) সঙ্গে হওয়া সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই পরাক্রমশালী গাঙ্গুবাঈ হয়ে উঠেছিলেন কামাতিপুরার নেত্রী। যৌনকর্মীরা যে সমাজের একটা অঙ্গ, তা জোর গলায় বলেছেন গাঙ্গুবাঈ।
যৌনকর্মীদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া থেকে আরও নানা বিষয়ে অধিকারবোধ নিয়ে বারবার সোচ্চার হয়েছেন এ মাফিয়া কুইন। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে যৌনবৃত্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আরজি জানিয়েছিলেন গাঙ্গুবাঈ। তিনি চেয়েছিলেন কামাতিপুরার অন্ধকার গলিতে আলোর রশ্মি পৌঁছে দিতে। তবে যৌনকর্মীদের অধিকারের লড়াইয়ে গাঙ্গুবাঈ পাশে পেয়েছেন রহিম লালা (অজয় দেবগন), সাংবাদিক বন্ধু (জিম সরাভ), কমলি (ইন্দিরা তিওয়ারি)-এর মতো বন্ধুদের। আফসানের (শান্তনু মাহেশ্বরী) সঙ্গে গাঙ্গুবাঈয়ের প্রেম একমুঠো তাজা বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছে। রহিম লালা গাঙ্গুবাঈকে ছোট বোন হিসেবে দেখতেন।
রহিম লালার সঙ্গে গাঙ্গুবাঈয়ের বন্ডিং ছবিটিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। এদিকে গাঙ্গুবাঈকে সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মানুষ ছাড়া লড়তে হয়েছে শীলা মাসি (সীমা পহওয়া), রজিয়া বেগমের (বিজয় রাজ) মতো মন্দ মানুষের সঙ্গে। ছবিতে রজিয়া বেগমের সঙ্গে গাঙ্গুবাঈয়ের দৃশ্যগুলো শিহরিত করে।
গাঙ্গুবাঈকে ঘিরে এ ছবির সমগ্র কাহিনি। তাই প্রথমেই উঠে আসে আলিয়ার অভিনয়ের কথা। গঙ্গা থেকে গাঙ্গুবাঈ হয়ে ওঠার প্রতিটি দৃশ্যে আলিয়া ছিলেন অনবদ্য। তাঁর অভিনয়ে ধরা পড়েছে ১৪ বছরের গঙ্গার ছেলেমানুষি, আবার মধ্যবয়সী গাঙ্গুবাঈয়ের দাপট। বোঝা যাচ্ছিল আলিয়া গাঙ্গুবাঈ হয়ে উঠতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিংড়ে দিয়েছেন। আলিয়ার অভিনয়ে ধরা পড়েছে একটি নারীর প্রতিটি অনুভূতি। কখনো তিনি মায়া-মমতাময়, আবার কখনো স্পষ্টভাষী, বদমেজাজি এক নারী। আবার প্রয়োজন পড়লে হিংস্র হয়ে উঠেছেন গাঙ্গুবাঈরূপী আলিয়া।
গাঙ্গুবাঈয়ের ম্যানারিজম থেকে তাঁর মেজাজ খুব সুন্দরভাবে পর্দায় মেলে ধরেছিলেন তিনি। কিছু কিছু দৃশ্যে আলিয়ার অভিনয় আপনার চোখ ভিজিয়ে দেবে। বিশেষ করে এক সভায় বক্তৃতার দৃশ্য বা দীর্ঘ সময় পর মায়ের সঙ্গে ফোনালাপের দৃশ্যে আলিয়া ছিলেন অনবদ্য। প্রিয় বান্ধবী কমলিকে চিরতরে হারানোর দৃশ্যেও তিনি ছিলেন অসামান্য।
এবার আসা যাক আলিয়ার লুকের প্রসঙ্গে। এ ছবিতে তাঁকে রঙিন পোশাকে খুব কমই দেখা গেছে। পর্দায় নায়িকাদের সৌন্দর্য কীভাবে মেলে ধরতে হয়, তা বানসালির মতো করে আর দ্বিতীয় কোনো পরিচালক এত ভালো জানেন না। ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবিতে আলিয়াকে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি সাদা সুতির শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, কপালে লাল বড় টিপ আর মাথায় সাদা ফুলের সাজে। আলিয়ার এই শ্বেতশুভ্র লুক ছবিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। বানসালির এ ছবিতে বাকি সব অভিনেতা পুরোপুরি ন্যায় করেছেন।
করিম লালার চরিত্রে স্বল্প উপস্থিতিতে অজয় দেবগন নিজের ছাপ রেখে গেছেন। এ ছাড়া সীমা পাহওয়া, বিজয় রাজ, জিম সরাভ, ইন্দিরা তিওয়ারি, শান্তনু মহেশ্বরী প্রত্যেকে ছিলেন অভিনব। সব মিলিয়ে ছবির কাস্টিং ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’র এক বড় প্লাস পয়েন্ট।
‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ অভিনয়। ছবিতে প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী নিজের দাপট দেখিয়েছেন। বানসালির সিনেমাটোগ্রাফি সব সময় প্রশংসিত হয়েছে। এ ছবিতে বানসালির স্পর্শে মুম্বাইয়ের অন্ধকার গলিও যেন আলোময় হয়ে উঠেছিল।
আর বানসালির সেট নির্মাণ যে কতটা সুন্দর হয়, তা আগে আমরা সাক্ষী হয়েছি। ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবিতেও ৬০-এর দশকের কামাতিপুরাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরেছেন তিনি। ছবির শেষ দৃশ্যটি খুব সুন্দরভাবে দৃশায়িত করেছেন পরিচালক। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও ভালো। তবে অভিনয় ছাড়া এ ছবির অন্যতম বড় সম্পদ সংলাপ। বিশেষত ছবির দ্বিতীয়ার্ধে একের পর এক জোরালো সংলাপ সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।
বানসালির সিনেমা মানে এক ম্যাজিক্যাল সংগীত আবহ ধরা পড়ে। কিন্তু এ ছবিতে তিনি সেই আবহ পুরোপুরি সৃষ্টি করতে পারেননি। এক–দুটি গান ছাড়া মনে রাখার মতো আর গান ছিল না। ছবির চিত্রনাট্য কিছুটা নড়বড়ে ছিল। ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ ছবির প্রথমার্ধ থেকে দ্বিতীয়ার্ধ অনেক বেশি মজবুত। তবে এ ছবিটি শুধু আলিয়ার জন্য একবার দেখা উচিত।