সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল সংসদে পাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫১ পিএম, ২৪ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:১৯ এএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ পাস হয়েছে। বিলে ১৮ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পূর্তির পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও এই আইনের আওতায় নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করে পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। আজীবন বলতে পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদে বিলটি পাস হয়। এটি পাসের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে বিলের ওপর আনিত জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো কণ্ঠ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে কতিপয় সংশোধনী গৃহীত হয়।
পেনশন আইনে বলা হয়েছে, চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, নিম্নআয় সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। বিলে বলা হয়েছে, একজন পেনশনার আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। আইনে পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে এবং পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি অথবা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা পেনশন ব্যবস্থার আওতা বহির্ভূত থাকবে। সরকার আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রজ্ঞাপন জারি করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করবে। এই আইন কার্যকর হওয়ার পর সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। যার প্রধান হবেন নির্বাহী চেয়ারম্যান। অপর চার জন কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এদের নিয়োগ করবে সরকার। তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। সরকারের অনুমোদন নিয়ে এ কর্তৃপক্ষ ঋণ নিতে পারবে বলে বিলে বলা হয়েছে। এছাড়া আইনের পেনশন ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৬ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, এপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এর সদস্য হবেন। পর্ষদের সদস্য সচিব হবেন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের দফা (ঘ) এর বিধান অনুযায়ী, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ও অন্যান্য অভাবগ্রস্তের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের বিধান অন্তভুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন আবশ্যক। উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ও দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিতকল্পে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন বিলটি প্রণয়ন করা সমীচীন
বিলের ওপর আলোচনা:
পাসের আগে বিলটি সরাসরি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বিলটি পাস না করে ফেরত পাঠানো বা জনমত যাচাই বা বাছাই কমিটিতে প্রেরণের পক্ষে বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, ফখরুল ইমাম, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু। বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, বিলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটি চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু এই পেনশন–ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সাড়া পাওয়া যাবে না। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পান, তার সঙ্গে অনেক কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ রিটার্ন কীভাবে পাবে, তা পরিষ্কার নয়। এটা অনেকটা ব্যাংকিং প্যাকেজের মতো। এই বিল পাসের আগে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া উচিত।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, বিলের কথাগুলো ভালো। কিন্তু এই পেনশন স্কিমে সরকারের অংশগ্রহণ কী? সরকারের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এটা ব্যাংকের ডিপিএস স্কিমের মতো। গুঞ্জন আছে, সরকারের কি টাকার অভাব হয়েছে যে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলবে? টাকা পাচার, বিদেশে বাংলাদেশিদের বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে মুজিবুল হক বলেন, অর্থমন্ত্রী কথা কম বলেন। বোবার শত্রু কম। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কানে কথা পৌঁছায় কিনা, জানা নেই। তার কোনো ফিডব্যাক, উদ্যোগ দেখা যায় না।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, বিলটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।’ এগুলো নাগরিকের অধিকার৷ কিন্তু এই আইনে বলা হচ্ছে, মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সরকার আবার ফেরত দেবে। এই বিল পাস করার কোনো সুযোগ নেই।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আপাতদৃষ্টে আইনটি ভালো। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে প্রভিডেন্ট করে, এটি তার বাইরে কিছু বলে মনে হয় না। সরকার কী মুনাফা দেবে, তা পরিষ্কার নয়। তিনিও দাবি করেন, এ আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমানও দাবি করেন, এই বিলের সংবিধানের সঙ্গে মিল নেই।
জাতীয় পাটির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা রাখার মতো। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে আর ব্যাংক দেদার টাকা বিদেশে পাচার করবে। ব্যাংকগুলো মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলো বারোভূঁইয়াদের কাছে চলে গেছে। সব সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। এ সময় বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেখার কেউ নেই। যারা টাকা পাচার করছে, তাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
বিরোধী দলের সদস্যদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিলটি আনার আগে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। যাঁরা লিখিত মতামত দিয়েছিলেন, তাদের মতামত আমলে নেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কমিটিতেও বিলটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিলটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে বিবেচনায় এটি সংসদে আনা হয়েছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বলেন, তার এক শিক্ষক ৩৬ বছর চাকরি করার পর এখনো পেনশনের টাকা তুলতে পারেননি। জনগণ পেনশনের টাকা জমা দেবেন কিন্তু তারা তো অফিসের বারান্দাই চেনেন না। এই টাকার নিরাপত্তা কী? যাঁরা একবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাদের জন্য আজীবন পেনশন স্কিম চালু করার দাবি জানান তিনি।