বছরজুড়ে চুনোপুঁটিতে আটকে ছিল দুদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:২৫ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:০৯ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বর্ষপঞ্জি বা ঘড়ির কাঁটা- যেভাবেই বলি, সময়ের হিসাবে ২০২২ গত হয়ে গেলো। বছরের শেষ প্রান্তে এসে হিসাবের কড়ি গুনছে সবাই। সব ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানই শেষ কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানেও বছরের হিসাব-নিকাশ শেষ হতে চললো বলে। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে করেন শাসন বিশেষজ্ঞরা। সে হিসেবে আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট রাষ্ট্রের প্রধানতম দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চলতি বছরটি কেমন ছিল? দুদক এখনও চলতি বছরে পরিপূর্ণ কোনো পরিসংখ্যান বা বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তবে যতটুক করেছে সেটি দেখলেও বছরের একটি বড় চিত্র উঠে আসতে পারে।
সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কমিশনে ১৮ হাজার ১৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যাচাই-বাছাই করে ৮৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে কমিশন। যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে, ১১ মাসে আসা অভিযোগের ১৪ হাজার ১১৯টি আমলেই নিতে পারেনি দুদক। যা মোট অভিযোগের ৭৮ শতাংশ।
এছাড়া অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা মনে না করায় ৩ হাজার ৬০টি অভিযোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যা মোট অভিযোগের ১৭ শতাংশ। দুদক বলছে, ২০২১ সালের তুলনায় এ বছর অভিযোগ বেড়েছে ৪২ শতাংশ। কমেছে মামলা দায়ের ও চার্জশিটের পরিমাণ। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ১১ মাসে ৩১২টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি করেছে কমিশন। অবৈধ সম্পদের অর্জন করার প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে ৮৯টি সম্পদের নোটিশ জারি করেছে সংস্থাটি। দুদকের অনুসন্ধান শেষে অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে ২৭৬টি মামলা দায়ের করে। আর এই সময়ে ১৬২টি মামলার চার্জশিট দিয়েছে কমিশন।
অভিযোগের তুলনায় অনুসন্ধান কম হওয়ার কারণ জানিয়ে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক বলেন, ‘যে পরিমাণ অভিযোগ এসেছে তার বেশিরভাগই অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারে না কমিশন। কারণ, এসব অভিযোগের একটি বড় অংশই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। যে কারণে দুদকের সেসব অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার নেই। তফসিলভুক্ত না হলে আমরা অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারি না। ’
ফেব্রুয়ারি জুড়ে শিরোনাম ছিল শরীফ কান্ড :
২০২২ সালের শুরুতে দুদকের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দুদকের উপসহাকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতির ঘটনা। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধিতে ৫৪(২) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি হতে অপসারণ করা হয়। শরীফ উদ্দিনের অপসারণ প্রত্যাহারে দাবিতে সেই সময় নজিরবিহীন আন্দোলনে নামে দুদক কর্মকর্তারা। স্মারকলিপি দেয় সংস্থাটির সচিব মাহবুব হোসেন বরাবর। শরীফ নিজেও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন। অপসারণ প্রত্যাহার করে তাকে যেন পুনর্বহালের দাবি করেন। পরে বিষয়টি আদলতে গড়ায়। শরীফের সহকর্মীরাই বলছেন তাকে অপসারণ করা অসাংবিধানিক। দুদক কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কমিশনে দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, সংবিধানের ১৩৫(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না। ’
জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর- প্রতি মাসেই পিকে হালদার :
গত হয়ে যাওয়া ১২ মাসে খবরের শিরোনামে রয়েছেন দেশের আর্থিক খাতের সবে চেয়ে বড় লুটেরা এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও রিলায়েন্স ফিন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। যদিও তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১৮ সালে। তবে চলতি বছরের ১৩ মে মধ্যরাতে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্তৃক আটক হন তিনি। বেশ কয়েকবার রিমান্ড হয় তার। এখন তিনি ভারতেই বন্দি। শিব শঙ্কর ছদ্মনামে ভারতে আটক পিকে হালদারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৪টি মামলা দায়ের করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ২৩ ও এফএএস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ১৩ মামলা। এছাড়া কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক।
১১৬ আলেমকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা গণকমিশন:
বছর জুড়ে সাধারণ মানুষের আলোচনা সমালোচনা ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে ‘গণকমিশন’। গত ১১ মে জঙ্গি অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে কাজ করছে এমন ১১৬ ওয়ায়েজিনের (ধর্মীয় বক্তা) একটি তালিকা দুদকে জমা দেয় সংগঠনটি। দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে দেওয়া গণ কমিশনের শ্বেতপত্রটি ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গণ কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজসহ পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এই শ্বেতপত্র তুলে দেন। এতে মামুনুল হকসহ দেশের শীর্ষ ১১৬ সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম রয়েছে।
বালুখেকো সেলিম :
চাঁদপুর সদরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলোচিত সেলিম খান। যাকে সবাই বালুখেকো সেলিম হিসেবে চেনেন। গত এক দশকে পদ্মা ও মেঘনা থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলনসহ নানা অবৈধ ব্যবসা করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গিয়ে চলতি বছর দুদকের মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। ২০২২ সালে সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে আটকই ছিল বছরে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গত ১ আগস্ট সেলিম খানের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। মামলায় বলা হয়, সেলিম অবৈধ উপায়ে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
যেসব ইস্যু আলোচনায় ছিল:
২০২২ সালে সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক-বর্তমান মন্ত্রী-এমপিদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আসলেও সেই অর্থে দৃষ্টান্তমূলক কিছুই করতে পারেনি সংস্থাটি। ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের অফিসে দুদকের অভিযান, তিতাস গ্যাস ও বিমান বাংলাদেশের অফিসে কয়েক দফা অভিযান ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে দুদকে। কিন্তু চুনোপুঁটি ছাড়া বিশেষ কাউকে আটক-গ্রেফতার বা মামলা করতে পারেনি সংস্থাটি। দুয়েকজন হেভিওয়েটের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদনের পরেও সরে আসে সংস্থাটি।
অভিযোগ এলেও আমলে নিতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যেসব অভিযোগ আসে তা অনেক সময় অসম্পূর্ণ থাকে। কমিশনে যে কয়টি সোর্সের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ করা হয় তার একটি সরাসরি বা ডাকযোগ। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদও অভিযোগ হিসেবে নেওয়া হয়। কমিশন অভিযোগগুলো প্রাথমিক সত্যতা পেলে তা অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। দুদক মনে করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমিশনের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় অনেক মামলা ছেড়ে দিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(ঠ) সম্পৃক্ত ২৭টি অপরাধের মধ্যে কেবল একটি অপরাধ ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র অনুসন্ধানের এখতিয়ার রয়েছে দুদকের।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দুদক সচিব মাহবুব হোসেনের স্বাক্ষরে চিঠিটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। এতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ২(ঠ) ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯-এর তফসিলে বর্ণিত সাতটি অপরাধের এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের বিষয়ে সংশোধনের তাগিদ দেওয়া হয়। বর্তমানে কেবল ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে দুদক। আরও যে সাতটি অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার চাইছে দুদক, সেগুলো হলো- মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯-এর তফসিলে বর্ণিত দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ (৩ নং), প্রতারণা (৫ নং), জালিয়াতি (৬ নং), দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার (১৪ নং), চোরাচালানি ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ (১৮ নং), করসংক্রান্ত অপরাধ (১৯ নং) ও পুঁজি বাজার সংক্রান্ত অপরাধ (২৫ নং)।