বিদেশে দাসত্বের শিকার বাংলাদেশি কর্মীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৩৭ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৪৯ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে দাসত্বের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। দালালের প্রতারণায় কয়েক গুণ বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি পান না। চাকরি পেলেও দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এর বিপরীতে ন্যায্যা মজুরি দূরে থাক নিয়মিত বেতন পর্যন্ত পান না। বিশ্রাম ও ছুটি মেলে না। শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু এবং মাইগ্রান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) আয়োজিত 'মজুরি চুরি বিষয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের গণসাক্ষ্য'- এ চিত্র উঠে আসে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ অনুষ্ঠানে বিদেশে নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে ফেরা ১২ জন কর্মী তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের দিয়ে মজুরি দাসত্ব চলছে। তাঁরা চারটি পর্যায়ে অবিচার, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে একজন কর্মীকে আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১৮ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে, যা মজুরি দাসত্ব। ভিসা ব্যবসার নামে কর্মী প্রেরণকারী ও নিয়োগকারী দুই দেশেই দুষ্ট চক্র গড়ে উঠেছে। তারা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বলীয়ান। দুষ্টুচক্রের কারণেই বৈধভাবে বিদেশে গিয়েও অবৈধ হচ্ছেন কর্মীরা।
কুমিল্লার বাসিন্দা এক নারী শ্রমিক জানান, তাঁকে হাসপাতালে আয়ার চাকরি দেয়ার কথা বলে সৌদি আরব নিয়ে বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ দেয়া হয়। কুমিল্লা ওভারসিজ নামের রিক্রুটিং এজেন্সি দেড় লাখ টাকা নিয়ে তাঁকে বিদেশ পাঠিয়ে ছিল। তিন মাস কাজ করেও বেতন পাননি। খাবার দেয়া হতো না। ঠিক মতো ঘুমাতেও দিত না কফিল (নিয়োগকারী)। দিনে ১৮ ঘণ্টা বাড়ির সব কাজ করাতো। কাজে ভুল ত্রুটির অজুহাতে মারধর করা হতো। দেশে ফিরে বিএমইটিতে অভিযোগ করলে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ মাত্র ৩০ টাকা পেয়েছেন। কুমিল্লার আরেক নারী কর্মীও সৌদি আরবে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞা তুলে ধরেন।
তিনি জানান, দিনে মাত্র দুটি রুটি দেয়া হতো। এক মাস কাজ করার পর বেতন না দিয়ে দালালরা জিম্মি করে নির্যাতন করে। মুক্তির জন্য তিন লাখ টাকা দাবি করে। পরে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন।
কেরানীগঞ্জের ওমর ফারুব জানান, পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে লেবানন গিয়েছিলেন। ১১ বছর পর শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন। বিমা, চিকিৎসা ও পরিবহন খরচ কিছুই পাননি। অথচ চাকরি করার সময়ে এসব টাকা বেতন থেকে কেটে রাখা হয়েছিল।
রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার মূল ধারনাপত্র পাঠ করে বলেন, ভারত, ফিলিপাইন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় অভিবাসী কর্মীদের মজুরি চুরির বিষয়টি এসেছে। কাঠামোগত মজুরি চুরি চলছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা মৃত্যুর পরও প্রাপ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ পান না। মৃতের উত্তরাধিকারীরা আইন লড়াইয়ের খরচের ভয়ে প্রতিকার চান না।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ঢাকায় বসে একজন কর্মী ২০ হাজার টাকা বেতনের চুক্তি করে, বিদেশে গিয়ে পান ১০ হাজার টাকা। পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ায় কর্মী কোথাও যেতে পারেন না। মধ্যপ্রাচ্যের মালিকদের ধারণা, শ্রমিক হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অধিকার নেই। সম্পর্ক খারাপও হওয়ার ভয়ে নিয়োগকারী দেশের সঙ্গে কর্মীর অধিকার নিয়ে সরকার কথা বলে না। প্রবাসী কর্মীদের পাওনা আদায়ে সরকারের করণীয় রয়েছে। রেমিট্যান্স নিয়ে গর্ব করা হলেও কর্মীদের খবর রাখা হয় না। করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের জন্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয় অনুষ্ঠানে। এ নিয়ে কর্মী প্রেরণকারী দেশগুলো মিলে নিয়োগকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেয়া হয়। মঅনুষ্ঠানে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ূয়াসহ আরও অনেকে বক্তৃতা করেন।