টেকনাফে বিজিবি-বিজিপি পতাকা বৈঠক, মিয়ানমারের দুঃখ প্রকাশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৬ পিএম, ৩০ অক্টোবর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
সীমান্তে গোলাগুলি ও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গোলাবর্ষণে মর্টার শেল এসে পড়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির কর্মকর্তারা। ভবিষ্যতে এ ধরনের গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। একইসাথে সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বিজিবির সাথে যৌথভাবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তারা সীমান্ত প্রটোকল অনুসরণ করবে বলে আশ্বস্ত করেছেন এবং সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত দুই দেশের বাসিন্দাদের শান্তিপূর্ণ বসবাসের অঙ্গীকার করেছেন।
আজ রবিবার (৩০ অক্টোবর) কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদীর পাড়ে শাহপরীর দ্বীপে বিজিবি রেস্ট হাউজে অনুষ্ঠিত ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির প্রতিনিধিরা এই প্রতিশ্রুতি দেন বলে জানিয়েছেন বিজিবি কমান্ডার।
বিকেলে টেকনাফে বিজিবি ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার। পতাকা বৈঠকে সীমান্তে গোলাগুলি ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গোলাবর্ষণের জন্য মিয়ানমার প্রতিনিধির কাছে প্রতিবাদ জানানো হয়। ব্রিফিংয়ে বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আজিজুর রউফ বক্তব্য রাখেন।
পতাকা বৈঠকে সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচার ও অনুপ্রবেশরোধে যৌথভাবে কাজ করবে বলে দু'পক্ষই একমত পোষণ করেন বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে কক্সবাজারে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিপির মধ্যে এই পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
রোববার সকাল ১০টায় টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর শাহপরীরদ্বীপ জেটি ঘাট সংলগ্ন বিজিবির সোদান রেস্ট হাউজে পতাকা বৈঠকটি শুরু হয়। চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে বিজিপির প্রতিনিধি দল বিকেল তিনটায় নাফ নদী দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ ত্যাগ করেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ জেটি ঘাটে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল দুইটি স্পিডবোটযোগে পৌঁছে।
বিজিবি জানিয়েছে, গত প্রায় তিন মাস ধরে মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলমান সংঘাত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। সীমান্তের এ পরিস্থিতি নিয়ে শুরু থেকে দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে নানা পর্যায়ে যোগাযোগ চলছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিজিবির পক্ষ থেকে বিজিপির কাছে একাধিকবার চিঠি পাঠানোও হয়েছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার বিকালে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি বৈঠকে বসতে রাজি হয়। এ নিয়ে রোববার টেকনাফে বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্ণেল শেখ খালিদ বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের বিজিপির সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল টেকনাফে পৌঁছে। পরে সকাল ১০ টায় শাহপরীরদ্বীপ জেটি ঘাট সংলগ্ন বিজিবির সোদান রেস্ট হাউজে ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকটি শুরু হয়। এতে বিজিবির পক্ষে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখারের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেন। অপর দিকে বিজিপির মংডু ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল ইয়ে ওয়াই শো ৭ সদস্য বিশিষ্ট দলের নেতৃত্ব দেন।
সীমান্তের কাঁটাতার। দীর্ঘ এই কাঁটাতারের মাধ্যমে আলাদা হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। নিশ্চিত করেছে আলাদা দুটি রাষ্ট্রের পরিচয়। সীমান্তে বাংলাদেশ অংশে সবসময় বিরাজ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থা। কিন্তু পাশের দেশ মিয়ানমারে গত ৩ মাস ধরে চলছে গোলাগুলি, যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ। প্রথমে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি ও মর্টার শেল বিস্ফোরণ। এর মধ্যে ২৮ আগস্ট মিয়ানমারে ছোড়া দুটি মর্টার শেল এসে পড়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। তবে বিস্ফোরিত না হওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ বিমান থেকে ছোঁড়া আরও দুটি মর্টার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। একই বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে উড়ে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার। যার কারণে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ে আতঙ্ক।
ধারাবাহিকভাবে চলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণ। এর মধ্যে ১৬ সেপ্টেম্বর আবারো বাংলাদেশে অভ্যন্তরে এসে পড়ে আরও কয়েকটি মর্টার শেল। যার মধ্যে শূন্যরেখা মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়ে মারা যায় এক রোহিঙ্গা আর আহত হয় ৬ জন। যার কারণে সীমান্তের বাসিন্দারা অনেকেই বসতি ছেড়ে আশ্রয় নেন স্বজনদের বাড়িতে। সীমান্তে বার বার এমন কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ডেকে কয়েক দফায় কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।
এতকিছুর পর তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলি ও গোলা বর্ষণ বন্ধ হতেই নতুন উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে শুরু হয় গোলাগুলি ও গোলা বর্ষণ। তারপর নতুন করে শুরু হয় টেকনাফ সীমান্তে। এভাবে সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে চলতে থাকে গোলাগুলি ও গোলা বর্ষণ। এরই মধ্যে চলতি মাসের ১০ অক্টোবর পরিস্থিতি দেখতে সীমান্তে আসেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ। সীমান্ত পরিদর্শনের পাশাপাশি দেখেন বিজিবি কার্যক্রম। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রতিবাদলিপি পাঠানোর পাশাপাশি বিজিপির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
ওই সময় বিজিবির মহাপরিচালক আরও জানিয়েছিলেন, সময় নির্ধারণ না হলেও পতাকা বৈঠকে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার।
তারপর চলতি মাসের ২৩ অক্টোবর নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নতুন করে শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি ও গোলা বর্ষণ। যা দু’দিন থেমে থেমে অব্যাহত থাকে। তবে এরপর থেকে আর শোনা যায়নি গোলাগুলি শব্দ।
এর মধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে সীমান্তে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে অবশেষে সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে বারবার কড়া প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি উত্তেজনা কমাতে মিয়ানমারের বিজিপির সাথে যোগাযোগ করে বিজিবি। পতাকা বৈঠকের প্রস্তাব দিলে অবশেষে দীর্ঘ ৩ মাস পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে সম্মত হয় মিয়ানমার।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, 'গত আড়াই মাস ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান গোলাগুলিকে কেন্দ্র করে সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের বাসিন্দারা আতংকে আছেন।'
'সীমান্তের এ পরিস্থিতি নিয়ে শুরু থেকেই ২ দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে নানা পর্যায়ে যোগাযোগ চলছিল। একাধিকবার বিজিপির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এই বৈঠক,' যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, 'সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বিজিবি কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।'