নির্বাচনি রোডম্যাপ : গতানুগতিক পথেই হাঁটছে বর্তমান কমিশন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:২৭ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫২ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রণয়নে বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশনের পথেই হাঁটছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের রোডম্যাপে থাকছে না কোনো চমক। চলতি মাসে প্রকাশ হতে যাওয়া নতুন ইসির কর্মপরিকল্পনা গতানুগতিক ধারাতেই হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এই রোডম্যাপ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার চিন্তা করছেন তারা। চলতি মাস থেকেই এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে। রোডম্যাপে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হিসেবে আগামী বছরের শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুর কথা বলা হয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসাবে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে ভোট অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশন ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল, বর্তমান কমিশনও তার আদলে তাদের নির্বাচনি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে।
বিদায়ী কমিশন তাদের কর্মপরিকল্পনায় ১. আইন কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, ২. নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, ৩. সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ৪. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সরবরাহ, ৫. বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ৬. নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং ৭. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলো রেখেছিল। তারই আলোকে বর্তমান কমিশনও তার রোডম্যাপে আইন সংস্কার, নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ; ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের শর্ত পূরণের তথ্য যাচাইয়ের বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দিচ্ছে। অবশ্য বিদায়ী কমিশন তার রোডম্যাপে সবার পরামর্শের বিষয়টি রেখেছিল এবং রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই তারা রাজনৈতিক দলসহ স্টেকহোল্ডারদের সাথে সংলাপ শুরু করেছিল। আর বর্তমান কমিশন তার রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার আগেই সংলাপটি সেরে ফেলেছে। বর্তমান কমিশন তার রোডম্যাপে নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, ভোটার সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম এবং পর্যবেক্ষণ সংস্থার নিবন্ধন ও নবায়ন কার্যক্রমের বিষয়টি উল্লেখ করছে। অবশ্য বিদায়ী কমিশন তার রোডম্যাপে এটি উল্লেখ না করলেও এই কাজগুলো করেছিল।
এদিকে বিগত হুদা কমিশন তার রোডম্যাপে নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন সময়ের মধ্যে কোন কাজটি করবে সেটি উল্লেখ করলেও বর্তমান কমিশন রোডম্যাপে কাজের সময় উল্লেখ করার পাশাপাশি এসব কাজের পেছনে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়গুলো তুলে ধরছে। এছাড়া রোডম্যাপে তারা সংলাপ থেকে যেসব পরামর্শ ও সুপারিশ পেয়েছে সেটাও তুলে ধরেছে। ইসি তার রোডম্যাপে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল তাদের শর্তাবলী প্রতিপালন করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছে। এ লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন শর্তাদি প্রতিপালন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহপূর্বক পর্যালোচনা করে নিবন্ধন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেবে এবং নতুন দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করবে। এ দুটি কাজই কে এম নূরুল হুদা কমিশন করেছিল। ওই কমিশন তথ্য যাচাই করে ৪টি দলের নিবন্ধন বাতিল করেছিল। অপরদিকে যোগ্য কোনো দল না পাওয়ায় তারা কাউকে নতুন নিবন্ধন দেয়নি। অবশ্য আদালতের আদেশে আবেদিত দলগুলোর মধ্যে দুটি নিবন্ধন পায়। নতুন ইসির রোডম্যাপে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা একক নয়। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও সমর্থক, ভোটার, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ এবং পর্যবেক্ষকদের ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। রোডম্যাপে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো কখন শেষ করা হবে এবং ইসির কোন শাখা তা বাস্তবায়ন করবে, এর সময়সূচি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়টিও আগের কমিশনের রোডম্যাপে দেখা গেছে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চ্যালেঞ্জগুলোও এতে উল্লেখ করা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা সৃষ্টি, প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন, অর্থ ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ, সব দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি অনুসরণ, নিয়মতান্ত্রিক প্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, পুলিশ ও প্রশাসন কর্তৃক বাধার সম্মুখীন না হওয়া এবং ভোটকেন্দ্রে প্রার্থী, এজেন্ট ও ভোটারদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করা। নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসির পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। শুধু মেট্রোপলিটন ও জেলা সদর আসনগুলোয় এ মেশিনে ভোট নেয়া হবে। নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগ দেয়া হবে।
ইভিএম প্রসঙ্গে কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত ১২টি রাজনৈতিক দল সরাসরি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) পক্ষে মত দিয়েছে। ৬টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। বাকি দলগুলো শর্তসাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। ওই শর্ত দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, এ মেশিনে ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইলিং) বা এ-জাতীয় কিছুর সংযোজন করা, যাতে ভোটাররা বুঝতে পারেন কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ভোটারদের মাঝে এ মেশিন পরিচিত করা এবং এতে কোনো কারচুপি করার সুযোগ না থাকলে এ মেশিন ব্যবহার করা। রোডম্যাপে ইসি বলেছে, ইভিএমে ভিভিপ্যাট সংযোজনের সুযোগ নেই। তবে ভিভিড্যাট রয়েছে, যাতে কে কত ভোট পেয়েছেন তার লগ থাকে। কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে ওই লগ থেকে আদালত সঠিক রায় দিতে পারেন। রোডম্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেন, খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে রোডম্যাপ প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেকহোল্ডারের কাছে তা পৌঁছানো হবে।
তিনি জানান, যেসব রাজনৈতিক দল সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছে, আর যারা বিপক্ষে বলেছে, তাদের সবার নাম রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ কী কী, তা মোকাবিলায় করণীয় কী, তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকেই ইসি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। আর বলতে পারেন রোডমাপ ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। রোডম্যাপ প্রণয়নে পূর্ববর্তী কে এম হুদা কমিশনের রোডম্যাপ অনুসরণ করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু বেসলাইন তো অনুসরণ করতেই হয়। আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ কিছু গতানুগতিক কাজ তো সবাইকেই করতে হয়। পাশাপাশি নতুন কমিশনের রোডম্যাপ হিসেবে কিছুটা ভিন্নতাও থাকবেই।
রোডম্যাপে নির্বাচনের আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক তাৎক্ষণিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ) এবং আচরণবিধিতে সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে যতদূর সম্ভব রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়া প্রার্থীদের জনসভা করার স্থান, তারিখ ও সময় শিডিউল করে দেয়ার বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে।
রাজনৈতিক দলের বিষয়ে রোডম্যাপে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮-এর আলোকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো বিধিবিধানের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা যাচাই করে দেখার জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর নতুন দলের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হবে আগামী জুনে।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যে নতুন দল নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ইসি। আইন সংশোধনের বিষয়ে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে আইন সংস্কারের খসড়া প্রস্তুত করা হবে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন সংস্কার কাজ শেষ করা হবে। সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের খসড়া তালিকা তৈরি করা হবে মার্চে। ওই তালিকার ওপর এপ্রিলে দাবি, আপত্তি ও সুপারিশ আহ্বান করা হবে।
রোডম্যাপে উল্লেখ রয়েছে- আগামী বছর মে মাসে শুনানি শেষে জুনে চূড়ান্ত সীমানার গেজেট প্রকাশ করা হবে। চলমান ভোটার তালিকা আগামী ২ মার্চ প্রকাশ করা হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিন শ সংসদীয় আসনের ভোটার তালিকার সিডি বিতরণ করা হবে। নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত সফটওয়্যার আগামী বছরের আগস্টের মধ্যে শেষ করা হবে। এছাড়া জুলাইয়ে খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ করা হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ওই কেন্দ্রের তালিকা দেয়া হবে। খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকার ওপর দাবি ও আপত্তি থাকলে আগস্টে তা গ্রহণ করবে কমিশন। ভোট গ্রহণের ২৫ দিন আগে চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ করা হবে।