যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ৩ বছরে ৪ লবিং ফার্মের ফসল : আইজিপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৯ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার নেপথ্যে তিন বছর ধরে বাংলাদেশিদের একটি চক্রের নিয়োগ দেয়া চারটি লবিং ফার্ম কাজ করেছে। এসব বাংলাদেশি অবয়বে বাঙালি হলেও তারা প্রকৃত বাঙালি না। তারা আর্টিফিসিয়াল বাঙালি বলেও মন্তব্য করেছেন আইজিপি। তিনি বলেন, ‘এরা দেশ ও দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকভাবেই ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে ‘যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক কমিটি’র উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের গুলশান ট্যারেসে এক নাগরিক সংবর্ধনায় বেনজীর আহমেদ এসব কথা বলেন। জাতিসংঘে পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র ইউনিটের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানসহ দলটির নেতাকর্মী, ব্যবসায়ীসহ বাংলাদেশিরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তা ও র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে তারা স্লোগান দেন।
আইজিপি বলেন, ‘আজকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি, যুক্তরাষ্ট্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এই দেশে অনেকবার এসেছি, এখানে লেখাপড়া করেছি, চাকরি করেছি। সেই যুক্তরাষ্ট্র আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমাকে তাদের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমি পশ্চিমা ভাবধারা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সেই মূল্যবোধটি হচ্ছে- গণতন্ত্রের মূল্যবোধ। মানবিকতা ও মানবাধিকারের মূল্যবোধ। আমি তাদের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী। আমি মানবিকতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধেই এটা হলো।’
বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি জানেন? সেটা একটি মজার বিষয়। তারা বলছে, ২০০৯ সাল থেকে নাকি দেশে ছয়শ’ লোক গুম হয়েছে। র্যাব নাকি গুম করেছে। আমি ভাই ২০০৯ সালে র্যাবে ছিলাম না, ২০১০ সালেও র্যাবে ছিলাম না (হাসতে হাসতে বলেন), আমি ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও ছিলাম না। আমি র্যাবে ২০১৫ সালে ছিলাম। যদি আমাকে ছয়শ’ লোকের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাহলে ওই সময় যারা ছিলেন, তাদের কী হবে? বিষয়টা কী এরকম- বেটা তুই করোনি, তোর দাদা করেছে, এই জন্য তুই দায়ী?’
আইজিপি বলেন, ‘আমি এজন্য আমেরিকান সরকারকে দায়ী করবো না। কারণ হচ্ছে, এটা ষড়যন্ত্রকারীদের তিন বছরের ফসল। চারটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিটি ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন (ডলার) করে দেয়া হয়েছে। এটা একশ’ মিলিয়নের প্রজেক্ট। এই নিষেধাজ্ঞা হলো তার ফলাফল। এর সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আমেরিকার সরকারকেও কোনো দোষ দেবো না, দায়ী করবো না। আমেরিকান নাগরিকরা তো লবিং ফার্ম নিয়োগ করেনি। কারা এই লবিং ফার্ম নিয়োগ করেছে, তা ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে। তারা কারা? তারা তো আমেরিকান লোক না, এখানে তারা বসবাসও করে না। তাই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং, আমি যেটা মনে করি, আমাদের সঙ্গে আমেরিকানদের একটা শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। তাদের নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের নাগরিকদের সম্পর্ক রয়েছে।’
বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, তখন আমি আমেরিকায় চাকরি করি। তাহলে তখন তারা আমাকে বের করে দিলো না কেন?’
তিনি বলেন, ‘‘আমেরিকানদের সঙ্গে আমাদের অনেক গোল সেট করা আছে। আমেরিকানরা সন্ত্রাসবাদের শিকার, আমরাও সন্ত্রাসবাদের শিকার। তাদের সব ঘোষণা ও নীতি রয়েছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের নীতিও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স।’ আমেরিকারও তা-ই। তো আমাদের লক্ষ্য এক।’’
বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আমেরিকা ম্যাক্সিকানদের মাধ্যমে মাদকের ভিকটিম, আমরাও মিয়ানমারের মাধ্যমে মাদকের ভিকটিম। আমরা ও আমেরিকা মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমেরিকা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আমরাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বিশ্বে আমেরিকা গণতন্ত্রের মডেল। আমরাও গণতন্ত্রে উন্নতি করেছি। এটাও আমাদের দুই দেশের একই লক্ষ্য। দুই দেশেরই এরকম অজস্র লক্ষ্য অভিন্ন। আমাদের সামাজিক উন্নয়নে আমেরিকার অবদান রয়েছে। তাই আমি বলবো, এই নিষেধাজ্ঞা যেটা হয়েছে, এটা অবয়বের বাঙালিরা করেছে। তারা ফার্ম নিয়োগ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের একক কিছু না, এটা সবার। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সবাইকে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ও নাগরিকদের প্রয়োজনে-একটি জেনারেশনকে দায়িত্ব নিতে হয়।’
আইজিপি বলেন, ‘ছয় শত লোক হারিয়ে গেছে, তারা কোথায়? তাদের নাম কী? তাদের ঠিকানা কী? তাদের কবর কোথায়? মতিঝিলে হেফাজতের প্রোগ্রামে নাকি তিন হাজার লোক মারা গেছে। পরে আমরা তাদের জিজ্ঞাস করলাম- যারা মারা গেছে তাদের নাম, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেন। তারা দিতে পারলো না। আমাদের দেশের এই অধিকার, স্বাধিকার, প্রাধিকার নামের কিছু এনজিও এগুলো করেছে। এই তথ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। সামনে কিন্তু আরও সমস্যা আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বাঙালির চার হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা নিজেরা নিজেদের কখনও শাসন করিনি। অনেকে সেন, পাল ও নবাব বংশের কথা বলেন। আসলে তারা বাঙালি ছিলেন না। অথচ এই বাংলা ছিল শস্য শ্যামল ও শস্যভা-ার। চার মাস কৃষকরা চাষাবাদ করতো। হিমালয় থেকে আসা পলির কারণে এই জমি ছিল উর্বর। এছাড়াও ছিল মাছ। মানুষ অভাবে ছিল না।’
আইজিপি বলেন, ‘বাঙালি হলো গোল্ডফিশ মেমোরি। আমাদের ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাস কী ছিল, তা আমরা কেউ মনে করি না। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের চেহারা কেমন ছিল? যাদের মনে আছে, তারা বলতে পারবেন। ১৯৭১ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয়, তখন পশ্চিমের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন—এই দেশ টিকবে না। তাদের যুক্তি ছিল— সাত কোটি মানুষের খাদ্য বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারবে না। প্রতিবছর ৬ থেকে ১৮ লাখ টন খাবার প্রয়োজন। এজন্য ধারাবাহিকভাবে আমাদের ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ হামলা করতো। কারণ, আমরা উৎপাদন করতে পারতাম না। আমরা প্রকৃতির ওপর নির্ভর ছিলাম। যে বছর বন্যা হয়েছে ফসল হয়নি, যে বছর খরা হয়েছে ফসল হয়নি। তাই আমরা ১৯৭১ সাল বা তার আগে খাবার উৎপাদন করতে পারতাম না।’
পুলিশের আইজি আরও বলেন, ‘সেই অর্থনীতিবিদদের আরও যুক্তি ছিল, এ দেশে রফতানির কোনো পণ্য নেই, শিল্প কারখানা এবং আমাদের খনিজসম্পদ নেই। তাই এই দেশ টিকবে না। ১৯৭২ সালে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, তা ছিল কৃষি খাতনির্ভর। কিন্তু এখন কৃষি খাতনির্ভর বাজেট কমতে কমতে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘সেসব অর্থনীতিবিদের মুখে ছাই দিয়ে, কেবল ছাই দিয়ে না, চুনকালি দিয়ে আমাদের অর্থনীতি কোথায় চলে গেছে। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না এলে আমাদের জিডিপি ১০ শতাংশ থাকতো এখন। কারণ, করোনার আগে আমাদের জিডিপি ছিল ৭.৫ শতাংশ। এটা বিশ্বব্যাংকের কথা। ২০৩০ সালে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪০ সালে আধুনিক দেশে উন্নতি হওয়ার কথা রূপকথা না। এটা বাস্তবতা। আমরা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। আমরা মাথা উঁচু করেই পৃথিবীতে বসবাস করবো।’
আইজিপি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আরেকটি দর্শন হলো—ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করা। আমরা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছি। বিশ্বে আমরা ৩৬তম বড় অর্থনৈতিক দেশ। কয়েক বছরের মধ্যে ২৪তম দেশে রূপান্তরিত হবো।’
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের রেফারেন্স দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার প্রিয় শিক্ষক আনোয়ার হোসেন। তিনি সেদিন একটি অনুষ্ঠানে একটি কথা বলেছেন, আমার খুব ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে দুই ধরনের বাঙালি, এক শ্রেণি প্রকৃত বাঙালি, আরেক শ্রেণি অবয়বে বাঙালি। অর্থাৎ, তারা আর্টিফিসিয়াল বাঙালি।’ এরা কখনও মুঘলদের দালালি করছে, আবার যখন ব্রিটিশ শাসকরা এসেছে, তাদের দালালি করেছে। একইভাবে যখন পাকিস্তানি শাসন হলো, তখন তাদের আনুকূল্য লাভের জন্য তাদের দালালি করেছে। ৬৯-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু দুটি বাদে সব আসন পেলেন, সেবারও ২৮ শতাংশ ভোট দেয়নি। এই ২৮ শতাংশ হলো আর্টিফিসিয়াল বাঙালি।’’
আইজিপি বলেন, ‘এদের সঙ্গে আমরা ভেতরকার একটি শত্রুতার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। আমাদের অন্তর্নিহিত লড়াই চলছে। এই চক্রটি দেশে ও মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তাদের লক্ষ্য কী আমি জানি না। এদের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু মুক্তির লড়াই আমাদের করতে হবে। মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশ, দেশের মানুষ, উন্নয়ন, উন্নয়ন অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই বাঙালি জাতি যখন ন্যায্যতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে, তখনই তারা বিজয়ী হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর। র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদ ছাড়াও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খান ও র্যাব-৭ সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।