আমলাদের বিদেশ সফর : মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৪ পিএম, ২৮ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:৩৯ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগকে এক কথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয় উদ্দেশ্য মহৎ, ফলাফল শূন্য। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের উদ্যোগকে অসংখ্য কর্মকর্তা সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১৩টি প্রকল্পের উদাহরণ দেয়া যায়। এই প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়ার একটি আনুষঙ্গিকতা ছিল। সিএজির অডিটে জানা গেছে, ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য মনোনয়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের ১৬ থেকে ২০ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের বেশি ছিল। সরকারি চাকরিতে অবসরগ্রহণের বয়সসীমা ৫৯ বছর। সুতরাং উল্লেখিত ব্যক্তিরা তাদের অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ পাওয়ার আগেই অবসরে চলে যাবেন। শুধু অবসরগ্রহণের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে যাওয়া কর্মকর্তাদের মনোনয়ন দেয়াই নয়, যারা বাস্তবায়নকারী সংস্থার অংশই নন (৩০ থেকে ৩২ শতাংশ) অথবা যারা মাঠপর্যায়ের প্রযুক্তি স্থানান্তরের নিরিখে অনেক উচ্চ পদে কর্মরত আছেন, তারাও এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হচ্ছেন। অর্থাৎ, এসব প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য; প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ ও স্থানীয় কৃষকের কাছে সেই প্রযুক্তি স্থানান্তরের উদ্যোগগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতাধীন ৭ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের উচ্চ-মানের ডাল, তৈলবীজ ও মসলা উৎপাদন, বছরজুড়ে ফলের চাষ ও উন্নত পানি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে সার্বিকভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায়। এ বিষয়ে জ্ঞান আহরণ ও তা হাতেকলমে মাঠ পর্যায়ে স্থানান্তরের জন্য ২২৮ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সিএজির অডিটে জানা গেছে, এদের মধ্যে ৪৫ জন মনোনীত ব্যক্তির বয়স ৫৫ বছরের বেশি। তাদের মধ্যে আবার ২৩ জনের বয়স ৫৮র চেয়েও বেশি। আরও ৭৩ জন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন এবং যাদের এসব প্রকল্পের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসূত্র নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। মৎস্য বিভাগের ৫টি প্রকল্পের আওতায় বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাস্তবায়নকারী সংস্থার সদস্য নন। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল মেরিন ফিশারিজ ও ব্রুড ব্যাংকের সক্ষমতা তৈরি, একটি গবেষণা কেন্দ্র ও ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা। ২টি প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত কর্মকর্তাদের ১৬ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের বেশি।
সিএজি উল্লেখিত বিভাগের কাছ থেকে এই অনিয়মের ব্যাখ্যা চাইলে সব সময় একই উত্তর দেয়া হয়, যা হলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হচ্ছে, কর্মকর্তারা বাংলাদেশে ফিরে কোনো প্রশিক্ষণ প্রতিবেদন জমা দেন না এবং দেশে ফিরে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোর কোনো প্রমাণ দেন না, যেটি বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত। সুতরাং, প্রশিক্ষণটি কোনো কাজে এসেছে কী না, অথবা এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কী না, সেটার কোনো প্রমাণ থাকছে না। সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রেই সিএজি কোনো সন্তোষজনক উত্তর পায়নি। সিএজির মতে, যেহেতু প্রকল্পের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হচ্ছে না, এই প্রশিক্ষণগুলোতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।
অন্যান্য উপায়েও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, যেমন বিদেশি প্রশিক্ষণ সেবা নেয়ার সুষ্ঠু প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এ খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়নি এরকম তহবিল ব্যবহার করে সরাসরি দরপত্র আহ্বান করা। সিএজি আরও জানতে পেরেছে, প্রকল্পের আওতায় বিদেশে শিক্ষা-সফরের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন বিল থেকে মূল্য সংযোজিত কর ও আয়কর কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ কমে যাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রশাসনিক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা তৈরির নামে বিদেশ সফর থেকে ব্যক্তিগত অর্জনই এখনকার সংস্কৃতি, যার উদাহরণ হচ্ছে ওসিএজির (সিএজির কার্যালয়) প্রতিবেদন।
তিনি আরও জানান, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওসিএজির প্রতিবেদনে চিহ্নিত হওয়া ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও জানান, এ ধরনের অনিয়ম চলতেই থাকে, কারণ এ ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। যা করা দরকার তা হল, ৩ ধরনের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা। যারা অংশগ্রহণ করেছেন, যারা মনোনীত ব্যক্তিদের নির্বাচন করেছেন এবং যারা সফরের অনুমোদন দিয়েছেন। এ ধরনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে ওসিএজির প্রতিবেদনটি একটি কাগুজে বাঘে পরিণত হবে এবং এই অবৈধ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে, যোগ করেন ইফতেখারুজ্জামান।