সংলাপের পর ইসি
কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে আনতে বাধ্য করতে পারে না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:১২ পিএম, ২২ আগস্ট,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০৭ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
নির্বাচনে সব দলের বিশেষত প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে প্রত্যাশিত বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন জানায়, নির্বাচন কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াস নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করবে না। তবে সব দলকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার আহ্বান শেষ অব্দি আন্তরিকভাবেই বহাল থাকবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে জানানো মতামতে এ কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আজ সোমবার এ সংক্রান্ত এ সংক্রান্ত লিখিত মতামত প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপিসহ ৯টি দল নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়নি। দুটি দলকে আবেদনের ভিত্তিতে আগামী সেপ্টেম্বর সংলাপে অংশগ্রহণের জন্য সময় দিয়ে সম্মতি দেয়া হয়েছে।
ইসির ১০ মতামত :
১. সব দল বিশেষ করে প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের মতামত হচ্ছে, কমিশন নির্বাচনে সব দলের বিশেষত প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করে। নির্বাচন কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াস নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করবে না। তবে সব দলকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার আহ্বান শেষ অব্দি আন্তরিকভাবেই বহাল থাকবে।
২. সঠিক ফলাফল নিশ্চিতকরণ, পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ সংক্রান্ত দলগুলোর প্রস্তাবের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধানের অধীনে প্রদত্ত সব ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সৃষ্ট সব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা করে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে কমিশন সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সেই সঙ্গে কারচুপির সম্ভাব্য সব সুযোগ প্রতিরোধ করে সঠিক ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করতে সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও সর্বোপরি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কমিশন কাজ করে যাবে। আগামী নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা এবং অন্যান্য বিভাগ থেকে কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের বিষয়টি কমিশন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করে দেখবে। কমিশন আরও মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার মাধ্যমে কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্যে উপনীত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা করে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখতে হবে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় অনিবার্য। প্রার্থীদের জয়-পরাজয় মেনে নিতে হবে। পরাজয় মেনে না নেয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। প্রার্থীরা প্রতিটি কেন্দ্রে কর্মী রেখে সক্রিয়ভাবে প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সৃষ্ট ভারসাম্য অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রভাব অনেকাংশে প্রতিরোধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠায় তা সহায়ক হবে। কমিশনের অভিমতে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তি দেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে অপচর্চার মাধ্যমে অপশক্তি হিসেবে অবাঞ্ছিত স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। এমন অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অবশ্যই সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে সমঝোতা ও মতৈক্য প্রয়োজন।
৩. ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত সুপারিশের ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত হলো- দেশি এবং বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকগণকে ভোট পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়া হবে। ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবাধ, নির্বিঘœ, স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করতে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে সিসি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরভাগের দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ, সামর্থ্য সাপেক্ষে প্রদান করা হবে।
৪. একাধিক দিনে নির্বাচন ও সেনা নিয়োগের বিষয়ে সিইসি বলেছেন, একাধিক দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিষয়টি নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে কি না, হলে তা কীভাবে সম্ভব হবে, দিনের ফলাফল দিনশেষে প্রকাশ করা হবে কি না, করা হলে তা পরবর্তীতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করা হয়েছে। বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করার আশা রাখে। দেশে একই দিনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয় বিধায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কাজে নিয়োজিত অসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা অপর্যাপ্ত বা অপ্রতুল হতে পারে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কাজে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাবনাটি যৌক্তিক বলে কমিশন মনে করে।
৫. ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বিষয়ে কমিশন মনে করে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি এবং সমর্থন দুই-ই রয়েছে। কমিশন তা শুনেছে এবং মতবিনিময় করেছে। ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে এর আগে সব দলের (কতিপয় দল অংশগ্রহণ করেনি) আমন্ত্রিত প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ ও কর্মশালা হয়েছে। এছাড়া বুয়েটসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি বিষয়ে সর্বজনবিদিত বিশিষ্ট অধ্যাপকদের অংশগ্রহণে একাধিক সংলাপ ও কর্মশালা হয়েছে। যেহেতু সদ্য সমাপ্ত রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও এর আগে ইভিএম নিয়ে আরও সংলাপ, কর্মশালা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং যেহেতু কমিশন ইভিএমের সার্বিক বিষয়ে এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি, সেহেতু সদ্য সমাপ্ত রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইভিএম নিয়ে এর আগে আরও যেসব কর্মশালা, মতবিনিময়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তার সার্বিক ফলাফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বিষয়ে যথাসময়ে অবহিত করা হবে। ব্লক চেইন পদ্ধতিতে বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে ঘরে বসে ই-ভোট প্রদানের প্রস্তাবটি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রয়োগ সম্ভব নয়। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা/সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
৬. অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল, এক মঞ্চে প্রচার ও ঋণ খেলাপের বিষয়ে সিইসি তার প্রতিবেদনে বলেছেন- অনলাইনে নমিনেশন পেপার দাখিল/গ্রহণের সুযোগ বা বিধান বর্তমানে আরপিওতে বিদ্যমান রয়েছে। একই মঞ্চ থেকে সব দলের প্রার্থীর বক্তব্য প্রদানের এবং প্রচারণার নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করার, নির্ধারিত স্থানে সব প্রার্থীর পোস্টার লাগানো বা লটকানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে একই পোস্টারে সব প্রার্থীর প্রচারণার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব আধুনিক। এতে নির্বাচনি ব্যয় কমে আসতে পারে। নির্বাচনি সহিংসতা হ্রাস পেতে পারে। রাজনীতিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির নতুন সংস্কৃতির প্রচলন সূচিত হতে পারে। ইউটিলিটি বিল বাকি থাকার কারণে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বিষয়ক বিধানটি যৌক্তিক করার বিষয়ে কমিশন বিবেচনা করবে।
৭. নির্বাচনকালীন সরকার সংশ্লিষ্ট সংলাপে আসা সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি জানান, নির্বাচন কমিশন মনে করে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। তবে কমিশন মনে করে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতা-বিবর্জিত নির্বাচনের প্রয়োজনে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়গুলোর ওপর দেয়া আছে, সেগুলোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ অবহিত ও সচেতন থাকবে এবং কোনো মহল থেকে সেগুলোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা বা বাধা সৃষ্টি যাতে না করা হয়, সংশ্লিষ্ট সব নির্বাহী বিভাগকে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব হিসেবে তা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন তার আইনগত অধিকার পুরোপুরি প্রয়োগ করবে। রাষ্ট্রের সব নির্বাহী বিভাগ স্ব স্ব অবস্থান থেকে সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব হিসেবে কমিশনকে সহায়তা প্রদান করবে। নির্বাচন কমিশন আশা করে সবার সমন্বিত প্রয়াস ও দায়িত্বশীল আচরণে সুস্থ, সুন্দর, অবাধ, অহিংস ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
৮. ক্ষমতাসীন দলের বাধা, মিথ্য মামলার বিষয়ে কমিশন মনে করে সাধারণ্যে এমন একটি ধারণা বা বিশ্বাস প্রবল। কমিশন দৃঢ়ভাবে আরও বিশ্বাস করতে চায় সরকারি দল এ ধরনের নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গজনিত কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং রাজনৈতিক কারণে কোনো মামলা করে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সময়ে সব অংশীজনের কার্যকলাপ কমিশন গভীর পর্যবেক্ষণে রাখবে।
৯. সংখ্যানুপাতিক সংসদীয় ব্যবস্থার সুপারিশের বিষয়ে সিইসি জানান, কমিশন পরামর্শটি গুরুত্ব সহকারে শ্রবণ ও বিবেচনা করেছে। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation) ও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Bicameral Legislature) গঠন করা, সংসদ সদস্যের সংখ্যা বর্ধিত করা এবং নারী আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তাবনাটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকার এবং জাতীয় সংসদের এখতিয়ারাধীন বলে কমিশন মনে করে।
১০. ক্ষমতা প্রয়োগের সুপারিশের বিষয়ে কমিশন বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলতে চায় যে, সংবিধানের অধীন গৃহীত শপথের প্রতি অনুগত থেকে সৎ, নিরেপক্ষ ও সাহসিকতার সঙ্গে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমান পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথগ্রহণ পূর্বক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর দাফতরিক বিভিন্ন কার্যসাধন ছাড়াও সুধীসমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সংলাপ করে এরই মধ্যে মতবিনিময় করেছে। নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ আয়োজন করে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ করে সংলাপের আয়োজন করে। গত ১৭ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল সংলাপে অংশগ্রহণ করে।