কূটনীতিকদের মুখ বন্ধ করতে দূতাবাসগুলোতে চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৩ পিএম, ২৯ জুলাই,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৩৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’ মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে সরকার। ঢাকার সব দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে এ সংক্রান্ত অভিন্ন নোট ভারবাল পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির একটি কপি পেয়েছে দিনকাল। যেখানে ১৮ জুলাই ডেটলাইন রয়েছে। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার একাধিক কূটনৈতিক মিশন সূত্র বলছে, নোট ভারবালটি বিদায়ী সপ্তাহেই মিশনে মিশনে পৌঁছেছে।
চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সকলকে সম্মানের সঙ্গে এটা স্মরণ করাতে চাই যে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বা কাজে কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার নীতি পুরোপুরি মেনে চলা উচিত। বিদেশি কূটনীতিকদের শিষ্টাচার মেনে চলার তাগিদ দিয়ে প্রায়শই এমন নোট পাঠানোর দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। নোট ভারবাল পাঠানোর আগে এবং পরে একাধিকবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপেও তিনি বিদেশিদের তৎপরতায় উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিদেশিদের মুখে কুলুপ আঁটতে মিশনে মিশনে চিঠি পাঠানোর এমন নজির বাংলাদেশে খুব একটা নেই বলে মনে করেন পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছে, নজিরবিহীন এমন চিঠি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরাবে।
বিশেষত: বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রশ্নে সরব পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীরা বিষয়টিকে মোটেও ভালোভাবে গ্রহণ করবে না, যা তারা এরইমধ্যে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। ওই চিঠির পর পশ্চিমা একাধিক দূত স্বাগতিক দেশে তাদের কী কাজ তা টুইট করে জানান দিচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, নোট পাঠানোর বিষয়টি একান্তই উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। সেখানে যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা ঢাকাস্থ বেশির ভাগ কূটনীতিক মেনে চলেন। তারা যেখানে যান তা অন্তত এসএমএস করে হলেও কোনো না কোনো অফিসারকে জানান। চিঠি পাওয়ার বিষয়টিকে অনেকেই ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক অবশ্য মনে করেন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো, মতামত দেয়া কূটনীতিকদের কাজ নয়। এমনকি একটি দেশে বিদেশি কূটনীতিকরা কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন বা কাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তা-ও ওই দেশের পররাষ্ট্র দফতরকে জানানো উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা অনেকেই মানেন না।
জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, সমপ্রতি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে হয়তো সরকার এটা চাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, সরকার হয়তো তার সক্ষমতা প্রকাশ করেছে এই চিঠির মাধ্যমে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিবর্তন আনছে।
ঢাকায় কূটনীতিকদের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা : গত ৪ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-র সঙ্গে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের কূটনীতিক? বৈঠকের পর প্রতিনিধি দলের পক্ষে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে চাই। এজন্য নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরও কার্যকর ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে যেকোনো প্রকার সহযোগিতা দিতেও আমরা প্রস্তুত।
ওইসিডি সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে আরও শানিত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করতে চায়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তখন জানান, ওটা ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো পরামর্শ দেননি। তারা নির্বাচনের আইন-কানুন ও প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এদিকে চিঠি পাওয়ার পরপরই ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি আওয়ামী লীগের সাাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। টুইট বার্তায় ২৪ জুলাইর সেই বৈঠকের বিষয়টি জানান দেন জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার।
বৈঠকের ছবি প্রকাশ করে তিনি লিখেন- স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব। প্রায় অভিন্ন টুইট করে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন। তিনি লিখেন- স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে একজন কূটনীতিক সকল অংশীদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সব সময়ই চেষ্টা করেন।
এদিকে গত ১৭ মার্চ ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপি নেতাদের। গুলশানস্থ বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদ। ওদিকে গত ২ জুন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে নাগরিক সমাজের ৫ জন প্রতিনিধিকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। ওই আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)-র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতীর শারমিন সোনিয়া মুর্শিদ। সেখানে কি কি বিষয়ে কথা হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ অভিযোগ করেন বিদেশি কূটনীতিকরা সারাক্ষণই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তারা কি ভারতে এটা পারবে? আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গান ফাইট বন্ধের কথা বলতে পারবো? তারা পরাশক্তি, তাই তাদের ব্যাপারে বলা যাবে না। কিন্তু আমরা দুর্বল, তাই তারা আমাদের ব্যাপারে বলবে।
তার মতে, বাংলাদেশে যখন যে বিরোধী দলে থাকে, তারা তখন কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেয়। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চায়। আর বিদেশিরাও সুযোগটি নেয়। অধ্যাপক ইমতিয়াজের মূল্যায়ন হচ্ছে- বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে। একক কোনো উন্নয়ন সহযোগীর ওপর নির্ভরতা কমেছে। তাই বাংলাদেশ চাইলেই এখন বিদেশিদের নাক গলানো বন্ধ করতে পারে। হয়তো তারই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এই চিঠির মাধ্যমে।