ভোটের মাঠের সহিংসতা ইসি বন্ধ করতে পারবে না : সিইসি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৩০ পিএম, ১৭ জুলাই,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভোটের মাঠের সহিংসতা নির্বাচন কমিশন (ইসি) বন্ধ করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সিইসি বলেন, আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা কিন্তু কম না। কিন্তু আপনাদের (রাজনীতিবিদ) দায়িত্ব নিতে হবে। এখানে খেলোয়াড় হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। আপনারা মাঠে যাবেন, খেলবেন। আমরা (ইসি) হলাম রেফারি।
আজ রবিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় ভোটের মাঠে সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক দলগুলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে ইঙ্গিত দেন সিইসি। নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটের মাঠে নিয়ম লঙ্ঘন করে কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ান, তাহলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকেও রাইফেল অথবা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেবো।
সিইসির এমন বক্তব্যের পর এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আইনে আমাদের শটগান নিয়ে দাঁড়ানো পারমিট করে না। এনডিএমের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপরে চাপাবেন না। আমরা আমাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দায়টা বহন করবো।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সরকার সহায়তা না করলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিণতি মন্দ হতে পারে। তবে ইসি আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
নির্বাচনের সময় কেউ ‘তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ালে’ প্রতিপক্ষকে ‘রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর’ পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, আপনি যদি (রাজনৈতিক দল) দৌড় দেন, তাহলে কী করবো? আমরা সাহায্য করবো। পুলিশের ও সরকারের ওপর ইসির ‘কমান্ড থাকবে’ বলেও জানান সিইসি। ‘আমোদ-ফুর্তি করতে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেননি’ বলেও এ সময় উল্লেখ করেন সিইসি।
তিনি বলেন, কঠিন দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, কঠোর পরিশ্রম করছি। সিইসি বলেন, আমরা সহিংসতা বন্ধ করতে পারবো না। আপনাদেরও (রাজনৈতিক দল) দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ খেলোয়াড় কিন্তু আপনারা। মাঠে খেলবেনও আপনারাই, আমরা রেফারি। আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে, সেটা কিন্তু কম না; ক্ষমতা প্রয়োগ করবো। আমি আপনাদের স্পষ্ট করে জানাতে চাচ্ছি- গত ১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপর চাপাবেন না। আমরা আমাদের নির্বাচনের দায় আমরা বহন করবো। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করতে কমিশন ‘সর্বাত্মক চেষ্টা করবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা ব্যর্থ হয়ে যাবো। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন, আমি বারবার বলেছি, রাজনৈতিক দল আর সরকার এক নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি সরকার প্রধান, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নন; এটি বুঝতে হবে। আমরা সরকারের সাহায্য চাইবো। সরকার যদি সহায়তা না করে, তাহলে নির্বাচনের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।
এর আগে স্বাগত বক্তব্যে সিইসি বলেন, ইতিপূর্বে আমরা বহুবার বলেছি যে, সকল রাজনৈতিক দলের বিশেষত প্রধানতম দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেয়া খুবই প্রয়োজন। কোনও দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অবশ্যই বাধ্য করতে পারবো না। তবে সকল দলকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে আমরা বারবার আহ্বান করে যাবো। সে প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সকল দলকে আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা না থাকলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হয় না। পক্ষ-প্রতিপক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাঠ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম, কারচুপি, দুর্নীতি, অর্থ শক্তির বৈভব ও পেশি শক্তির প্রয়োগ ও প্রভাব বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। কমিশন সকলের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করতে চায়। অন্যথায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রয়াস যতই আন্তরিক হোক, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটা কাম্য নয়।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উল্লেখ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, একটি মাত্র দল ৩০০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সাংবিধানিকভাবে কোনও বাধা নেই। তবে ইতিহাস বলে সেক্ষেত্রে অচিরেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবে। স্বৈরতন্ত্র মাথা জাগিয়ে তুলবে। গণতন্ত্রের আরাধ্য পুনরুদ্ধার হয়ে পড়বে দুরূহ।
সিইসি বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নানাবিধ আশা, হতাশা ও তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিতর্কগুলো নিরসন হওয়া প্রয়োজন। ইতিপূর্বে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা কয়েটি উন্মুক্ত সংলাপ করেছি। এতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কমিশনের সক্ষমতা ও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করে নিয়ে কারণগুলো বারবার ব্যাখ্যা করে বলেছি। ইভিএম নিয়ে পাঁচ-সাতটি কর্মশালা করার পর নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এবং বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত সভা করেছে। সেখানে কেউ কোনও ত্রুটি দেখাতে পারেনি বলে দাবি করেন সিইসি।
তিনি বলেন, ইভিএম এবং ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরপিও ২৬ অনুযায়ী, কারচুপির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো প্রতিপালন করা হলে কারচুপি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এত কিছুর পরও ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার চলছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ইভিএম সম্পর্কে বিভ্রান্তি-সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমরা সত্যি উদ্বিগ্ন হচ্ছি। কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনিয়ম, সহিংসতা, ব্যালট পেপার ছিনতাই হলে প্রতিরোধ কতটা সম্ভব হবে। আমাদের প্রত্যাশা জাতীয় নেতারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও মতৈক্য হয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিরসন করে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও সমতল ভিত্তি সৃষ্টি করবেন।
এ সময় তিনি অরাজনৈতিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদেরও সহযোগিতা কামনা করেন। তারা সংগঠিত হয়ে এগিয়ে এসে জাতির একটি সংকটময় মুহূর্তে তাদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞান প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংলাপে আহ্বান করে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন বলেও মনে করেন তিনি।
সিইসি বলেন, আমরা নির্বাচন করতে চাই অনুকূল পরিবেশ ও শক্ত ভিত্তির ওপর। এজন্য সকলের সহায়তা কাম্য। এনডিএম-এর সঙ্গে সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ঐকমত্য খুবই প্রয়োজন। আমরা দেখছি একটি বড় ঐকমত্য একদিকে, আরেকদিকে সরকার। আমরা খুবই দ্বিধান্বিত হই যখন তাদের বক্তব্যগুলো সাংঘর্ষিক হয়। আমরা চাই সমঝোতা করে এগিয়ে যাক।
যেকোনও পরিস্থিতিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অনেকে হয়তো ভয় পাচ্ছে, নতুন করে সরকার হলে তার একটা শর্ত থাকবে এই কমিশন। এজন্য আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই- এখানে সামান্যতম কোনও ভয়-ভীতি নেই। বলার আগেই পদ ছেড়ে দেবো। যদি সত্যিই নতুন কোনও যোগ্য নির্বাচন কমিশনের বিষয় আসে, তাহলে আমাকে আহ্বান করতে হবে না। আমি চাই সম্প্রীতি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও সমঝোতা। আমাকে দিয়ে না হোক, যে কাউকে দিয়ে হতে পারে। নির্বাচনের স্বার্থে যদি আমাকে পথ থেকে সরে যেতে হয়, তাহলে আমাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে না। রিকোয়েস্ট করার আগেই চলে যাবো। এই পদে কিন্তু আমরা আমোদ-ফুর্তি করতে আসিনি। কঠিন দায়িত্ব নিয়ে, কঠোর পরিশ্রম করতে এসেছি এবং কঠিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। এর জন্য আপনাদের সহযোগিতা সব সময় কামনা করছি।
সিইসির বক্তব্যের পাল্টা জবাবে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আমরা কেউ শটগান নিয়ে আসতে পারি না, কারণ আইন আমাদের পারমিট করে না। অন্য কেউ যদি পিস্তল নিয়ে আসে বা ১০০ জন মানুষ নিয়ে আসে, সেটা সরকারের পক্ষ থেকেই ট্যাকেল করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চয়তা দিতে হবে প্রশাসন নিউট্রাল থাকবে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে সংলাপে বসে কমিশন। এই সংলাপ ধারাবাহিকভাবে ৩১ জুলাই পর্যন্ত চলবে। এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এনডিএম-এর সঙ্গে সংলাপের পর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) সঙ্গে সংলাপ শুরু করে ইসি।