আ.লীগ ও শরিক ৩ দল ছাড়া সবাই ইভিএম বিরোধী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৫ পিএম, ২৯ জুন,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০২:০১ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের ৩ জোটসঙ্গী ছাড়া দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান জানান দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনকালীন সময়ের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জেএসডি) এরমধ্যে ইভিএম নিয়ে তাদের আপত্তির কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। এদিকে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা দীর্ঘদিন থেকেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল ‘ভোট চুরি’ করবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর ইভিএমের বিষয়টি আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছে। গত ৭ মে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এই বক্তব্য দেন।
১৬ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনানুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার সময় তৈরি হওয়া একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি প্রকাশ্যে আসার পর নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন ‘আস্থা’ অর্জনের পাশাপাশি ইভিএম নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করার জন্য ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় বৈঠক শুরু করে গত ১৯ জুন। ৩ পর্যায়ের এই মতবিনিময় সভা শেষ হয় মঙ্গলবার। কিন্তু বিএনপিসহ আরও ১১টি রাজনৈতিক দল গতকাল শেষ হওয়া এই আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ায় এই উদ্যোগটি একটি বড় ধাক্কা খায়।
সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জেএসডি) আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে ইভিএম ব্যবহারে শর্ত আরোপ করে জেএসডি বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে তা ভোটারদের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে উঠলেই কেবল এটি ব্যবহার করা যাবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ ও তার ৩ মিত্র দল আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি সমর্থন করছে। বিপরীতে ১২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ও ৭টি দল স্পষ্ট কোনো অবস্থান নেয়নি।
এছাড়া বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে বলেছে, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আগে সেগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার।
গতকালের আলোচনায় ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে বেসরকারি কর্মকর্তাদের পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করার প্রস্তাব দেয়।
নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এই আলোচনার শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে (নির্বাচনে) ইভিএম ব্যবহার নিয়ে অনেক আলোচনা শুনছি। কেউ কেউ এর পক্ষে ছিলেন। তবে অধিকাংশই এর বিপক্ষে।
তিনি জানান, ইভিএম সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা নেই। তবে যেহেতু তারা ইভিএম নিয়ে আলোচনা করছেন ও কাজ করছেন, তাই তারা এ বিষয়ে কিছু ধারণা পেয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, আলোচনার সময় কেউ কেউ বলেছেন যে, ইভিএমে নির্বাচন হলে তারা তাতে অংশ নেবেন না।
সিইসি আরও জানান, আলোচনায় অনেকে ইভিএমের পক্ষে বলেছেন, অনেকে এই পদ্ধতি উন্নত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই আগামী নির্বাচনে ইভিএম নাকি ব্যালট পেপার- কোনটি ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বলে জানান সিইসি। অনেক রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকের ধারণা, ইভিএম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইসির ওপর চাপ তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও আওয়ামী লীগের ইভিএম সমর্থনের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, যা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জানান, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কিনা, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার আছে নির্বাচন কমিশনের।
তার ভাষ্য, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ একজন সদস্য বলেছেন যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব আসনে ইভিএম চায়। এতে নির্বাচন কমিশনও চাপে পড়ে গেছে।
বদিউল আলমের আশঙ্কা, এ কারণে মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
নির্বাচনের কমিশনের আয়োজনে সাম্প্রতিক মতবিনিময় সভায় সুশীল সমাজের বেশ কয়েকজন সদস্য ও বিশিষ্ট নাগরিকরাও জাতীয় ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন।
নির্বাচন কমিশন যদি আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের সাড়ে ৪ লাখ মেশিনের দরকার হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কমিশনের হাতে আছে মাত্র দেড় লাখ ইভিএম।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় : ইভিএম নিয়ে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া অন্য দলগুলো হলো- কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি-রব), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। এগুলোর মধ্যে বিএনপির জোটসঙ্গী জেএসডি-রব, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, এটি একটি অবৈধ নির্বাচন কমিশন। সরকারের নির্দেশনা অনুসারেই তারা কাজ করে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে জাতীয় পার্টি (এরশাদ), গণফোরাম ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) জানিয়েছে যে, তারা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে।
জাতীয় পার্টি (এরশাদ) আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল এবং গণফোরাম বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান একটি দল। এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাপ সম্প্রতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে। বিপরীতে সংলাপে আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতান্ত্রিক পার্টি জানিয়েছে যে, তারা ইভিএমের পক্ষে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও সংলাপে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের দেয়া তথ্য অনুসারে যে ১২টি দল ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেগুলো হলো- বাংলাদেশ কংগ্রেস, গণফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্য জোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।