বন্যা : সবচেয়ে দুর্দশায় দুর্গম এলাকার মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫৬ পিএম, ২৪ জুন,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:২০ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সিলেট বিভাগের ৩৩৬ ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাসিন্দারা চরম দুর্দশায় আছেন। এই ৯৩টি ইউনিয়নের হাজারো মানুষ এখনো কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাননি বললেই চলে।
আরও ৬৭টি ইউনিয়নের মানুষও যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ না পেয়ে দুর্দশায় আছেন। প্রায় প্রতিটি জায়গায় প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ঠিকমতো এগোচ্ছে না। ব্যক্তি পর্যায়ের ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোরও একই অবস্থা। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারাই ঠিকমতো ত্রাণ পাচ্ছেন না।
প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বন্যা আঘাত হানার পর বেশ কয়েকদিন চলে গেলেও এখনো সেসব জায়গায় প্রয়োজন অনুযায়ী পৌঁছেনি।
এখনো যেসব বন্যাদুর্গত এলাকায় কোনো ধরনের ত্রাণ পৌঁছেনি, তার মধ্যে আছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের যথাক্রমে ৩৬, ৩৮, ৮ ও ১১টি ইউনিয়ন।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, ইতোমধ্যে এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে আসা ত্রাণ পেয়েছেন সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার ২৪টি উপজেলার ৫৭ হাজার ৮৬০ বাড়ির মানুষ।
ত্রাণ এখনো দুর্লভ : জৈন্তাপুর ইউনিয়নের চাতলারপুর গ্রামের বাসিন্দা আয়তুন গত ৯ দিন শুধু চিড়া খেয়ে বেঁচে আছেন। এই ইউনিয়নে বুক-সমান পানি উঠেছে প্রায় ১০ দিন আগে।
মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: দরবস্ত ইউনিয়নের পশ্চিম গর্ধনা গ্রামের অনেক মানুষ ত্রাণবাহী নৌকার কাছে পৌঁছানোর জন্য নিজ নিজ ডিঙ্গি নৌকা ব্যবহার করেন। যাদের এ ধরনের কোনো পরিবহন নেই, তারা বুক-সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে ত্রাণবাহী নৌকার আরোহীদের ডাকতে থাকেন।
এটাই ছিল সেখানে পৌঁছানো প্রথম ত্রাণবাহী নৌকা।
ডিঙ্গিতে অপেক্ষমাণ ফরিদুন বলেন, 'আমার ৬ সদস্যের পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য মাত্র ২ দিনের চাল আছে।'
'শেষবার এটুকু চালই আমি কিনতে পেরেছিলাম। আমরা বিছানার ওপর চুলা বসিয়েছি এবং এ কারণেই এখনো রান্না করতে পারছি', যোগ করেন তিনি।
১০টি উপজেলার মধ্যে কমলাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টা, মহানগঞ্জ ও খালিয়াজুরির মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় আছে।
খালিয়াজুরির বাসিন্দা রনি জানান, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উপযোগিতার সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের সমন্বয় করছেন।
স্থানীয় সাংবাদিক রাজিব সরকার গত ৬ দিনে বিভিন্ন বন্যাদুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ মানুষ অভুক্ত আছে। স্থানীয় প্রশাসন শুধুমাত্র কাছের এলাকাগুলোতে পৌঁছাতে পেরেছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।'
প্রশাসনিক সমস্যা: ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ জানান, তারা ১ হাজার ১০০ পরিবারের জন্য ত্রাণ হিসেবে ২৪ বস্তা চাল পেয়েছেন, যার অর্থ প্রতিটি পরিবারের জন্য মাত্র ১ দিনের খাবার পাওয়া গেছে।
বেশ কয়েকজন স্থানীয় কাউন্সিল প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক নিশ্চিত করেন, তারা যাতায়াত সমস্যা ও ত্রাণ সংকটের কারণে অসংখ্য বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও এসব সমস্যার সত্যতা মেনে নেন।
সিলেটে বন্যায় চিড়া-মুড়ি-গুড়ের দাম বেড়েছে দেড় গুণ: সিলেটের বিশ্বনাথের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার বলেন, 'এই উপজেলায় নৌকা খুবই দুর্লভ। যেসব সড়কে বন্যার পানি ওঠেনি, সেগুলো যাত্রাপথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও, এই উপজেলায় খুব বেশি বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।'
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসীর হাসান বলেন, 'হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলোতে যাওয়া খুবই ঝামেলার। যাতায়াতের সমস্যার কারণে সেসব দুর্গম এলাকার বন্যাদুর্গতদের কাছে খুব বেশি ত্রাণ পৌঁছায়নি।'
বন্যার পানি বাড়ছেই সংকট খাবারের : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গত এক সপ্তাহে মেঘনা ও তিতাস নদীতে প্রায় পাঁচ ফুট পানি বেড়েছে। এখনো পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া উপজেলায় প্রায় দশ হাজার হেক্টর জমির ধান, ১ হাজার হেক্টর জমির পাট খেত ও মৌসুমি শাক-সবজি পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয়দের দাবি। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন বলছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৩ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ত্রাণ ও ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত এক সপ্তাহে তিতাস ও মেঘনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনটি সেতু ভেঙে গেছে এবং বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়ে উপজেলায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা তলিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলার প্রায় ৭০০ পুকুর, প্রায় ১২ হাজার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ৬০০ মৎস্য খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বন্যা দুর্গতের আশ্রয়ের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলায় ৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫টি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাঁচ হাজার মানুষকে জরুরি পরি সেবার মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ থাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিন উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, নিচু এলাকার প্রায় ৮০ ভাগ বসতভিটা প্লাবিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে উপজেলার বেশ কয়েকটি বন্যা আশ্রয়ণকেন্দ্র আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক মানুষ।
ভলাকুট ইউনিয়নের খাগালিয়া গ্রামের আলফু মিয়া বলেন, ‘আমি একজন কৃষক। কোরবানি ঈদে বিক্রির জন্য ৪টি গরু কিনেছিলাম। কিন্তু নিজেই খেয়ে বাঁচতে পারব কি না এই চিন্তায় আছি। এখন যেভাবে পানি বাড়ছে আমার গরু ও পরিবারের ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় সমস্যায় আছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাইদ তারেক বলেন, ‘১৩টি ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও বন্যার্তদের দেওয়া তথ্য মতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমির বোনা আমন, ৩০ হেক্টর জমির রোপা আমন, ২০ হেক্টর জমির সবজি ও ২০ হেক্টর জমির পাট খেতের ক্ষতি হয়েছ।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. নুরে আলম সিদ্দিক বলেন, ‘উপজেলায় বন্যার কারণে গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত পাঁচ শ কেজি গো-খাদ্য সহায়তা দিয়েছে।’
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মেহেদী হাসান খান শাওন বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৩ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ত্রাণ ও ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।’