আরব আলীর বয়স বেড়ে ৫২ থেকে ৯২, বিচার শেষ হয়নি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫৮ পিএম, ১৪ জুন,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২৫ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
৩৮ বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের একটি শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন আরব আলী, তখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর। সে সময় জালিয়াতির মাধ্যমে ১৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। চাকরিও হারিয়েছিলেন তিনি। বছরের পর বছর পুরান ঢাকার বিচারিক আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের বারান্দায় ঘুরেছেন। চাকরি ফিরে পাওয়ার পক্ষে একবার আদালতের রায়ও এসেছিল। তবে উচ্চ আদালতে তা আটকে যায়। এরপর তিন যুগের বেশি সময়ে আরব আলীর অর্থ আত্মসাতের ওই মামলার বিচার এগোয়নি।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, আসামি কিংবা বাদী, উভয়ই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। এত বছর পরও মামলার বিচার শেষ না হওয়াটা চরম হতাশাজনক ব্যাপার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ আরব আলী রাজধানীর নয়াপল্টনে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। ৯২ বছর বয়সী এই ব্যক্তি ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। কিন্তু মামলার আসামি হওয়ায় তাকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এই মামলার বাদী ছাড়াও পাঁচ আসামির তিনজনই মারা গেছেন। মৃত তিন আসামির মধ্যে আরব আলীর এক স্ত্রী জাহানারা বেগমও রয়েছেন। দুই বছর আগে মামলার বিচারে নতুন করে অভিযোগ গঠন হয়, সেখানে আসামি শুধু আরব আলী ও তার জীবিত স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তবে মনোয়ারা আরও বেশি অসুস্থ। আদালতের অনুমতি নিয়ে সশরীর হাজিরা থেকে রেহাই পেয়েছেন তিনি। তার পক্ষে আইনজীবী নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন। সর্বশেষ গত ২৯ মে এই মামলার শুনানির দিন ঠিক ছিল। তবে অসুস্থ থাকায় সেদিন আর আদালতে হাজির হতে পারেননি আরব আলী। তার পক্ষে আদালতের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী। ওই দিন নয়াপল্টনে আরব আলীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি অসুস্থ। হাতে ক্যানুলা। ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। আরব আলী সেদিন বলেন, আমি খুব অসুস্থ। মামলার বিষয়ে আমার কিছু মনে নেই।
আরব আলীর ছেলে সৈয়দ আলী আহসান বলেন, আব্বা এখন আর কিছু সেভাবে মনে করতে পারেন না। মা তো আরও বেশি অসুস্থ থাকেন। এই মামলার বিচার এত বিলম্বিত কেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে আরব আলীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরের বছরই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। সেটি আমলেও নিয়েছিলেন আদালত। তবে আরব আলী সরকারের অনুমোদন না নিয়ে তার (সরকারি কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেন উচ্চ আদালতে। এই নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় ১৪ বছর। মামলার কার্যক্রম বাতিল করেন হাইকোর্ট। পরে রাষ্ট্রপক্ষে আপিলের শুনানি নিয়ে মামলাটি আবার সচলের রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। ২০০৪ সালে ওই রায় হলেও রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৩ বছর পর বিষয়টি বিচারিক আদালতের নজরে আনে। তত দিন মামলার বাদী, তিন আসামি ও সাক্ষীদের কেউ কেউ মারা গেছেন। এখন আদালত সাক্ষী আনতে বললেও রাষ্ট্রপক্ষ কাউকে হাজির করতে পারছে না।
আরব আলীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ : আরব আলী ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের ফকিরাপুল শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপক থাকার সময় আরব আলী জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করেন। পরে পৃথক ছয়টি চেকের মাধ্যমে অন্যদের সহায়তায় সেই টাকা তিনি উত্তোলন করেন। এ ছাড়া অস্তিত্ববিহীন ‘সার হিন্দ ট্রেডার্স’ নামের প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলেন। ঋণপত্রের বিপরীতে অন্যের স্বাক্ষর জাল করে যন্ত্রাংশ আমদানির নামে ব্যাংকের ৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। রূপালী ব্যাংকের আইনজীবী ইমাম হোসেন বলেন, মামলার বাদীর স্বাক্ষর চেনেন এমন একজন ব্যক্তিকে আদালত হাজির করতে বলেছেন। অন্য সাক্ষীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা কফিলউদ্দিন আশরাফী ১৯৮৪ সালের ১২ আগস্ট মতিঝিল থানায় আরব আলীসহ পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। তার দুই স্ত্রী ছাড়া অপর দুই আসামি শাহাদাত হোসেন ও ওজিউল্লাহ আরব আলীর পূর্বপরিচিত ছিলেন। তাদের সবার বাড়ি নোয়াখালী। এ মামলায় ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুর্নীতি দমন ব্যুরো। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে বদলি করা হয়। আরব আলী গ্রেফতার হওয়ার পর জামিন পান।
যেভাবে ঝুলেছে বিচার : আরব আলীসহ আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৮৫ সালের ২৪ এপ্রিল অভিযোগপত্র আমলে নেন বিচারিক আদালত। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আরব আলী উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তার পক্ষে উচ্চ আদালতকে বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সরকারি অনুমোদন না নিয়ে আরব আলীর বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগ আমলে নেন বিচারিক আদালত, যা আইনসিদ্ধ নয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বিচারিক আদালতকে জানানো হয়, আরব আলীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাই তার বিচারের জন্য সরকারি অনুমোদনের দরকার নেই। পরে ১৯৮৫ সালের ৪ নভেম্বর আরব আলীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এরপর এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন আরব আলী। তখন তার পক্ষে আদালতে বলা হয়, চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে তিনি দেওয়ানি আদালতে মামলা করেছেন। পরে ১৯৯০ সালে আরব আলীকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চাকরিচ্যুতির আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেন দেওয়ানি আদালত। ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে তখন দেওয়ানি আদালতের ওই রায় স্থগিত করেননি এই আদালত।
এদিকে মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আরব আলী যে আবেদন করেছিলেন, তার রায় হয় ১৯৯৮ সালের ২ জুলাই। রায়ে বলা হয়, আরব আলী চাকরিতে বহাল রয়েছেন। সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া অপরাধ আমলে নেয়ার এখতিয়ার বিচারিক আদালতের নেই। মামলার কার্যক্রম বাতিলের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। এরপর হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগ উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করেন। এর ১৩ বছর পর (২০১৭ সালের ২০ আগস্ট) আপিল বিভাগের এই রায়ের তথ্য বিচারিক আদালতকে জানানো হয়। রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবার মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি জমা দিলে আবার মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। তখন আদালতের পক্ষ থেকে আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়। পরে আসামিপক্ষ থেকে মৌখিকভাবে আদালতকে তিন আসামি শাহাদাত হোসেন, ওয়াজিউল্লাহ ও জাহানারা বেগমের মৃত্যুর কথা জানানো হয়। পরে ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি আরব আলী ও তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। তবে আদালতের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও ২৭ জন সাক্ষীর কোনো সাক্ষীকে হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, বাদী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক এম কে আশরাফী অনেক আগে মারা গেছেন।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের আইনজীবী ইমাম হোসেন বলেন, মামলার বাদীর স্বাক্ষর চেনেন এমন একজন ব্যক্তিকে আদালত হাজির করতে বলেছেন। অন্য সাক্ষীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর রেজাউল করিম বলেন, ৩৮ বছরের পুরোনো মামলা। মামলার সাক্ষীদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবু সাক্ষীর খোঁজ মিলছে না। এই মামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম বলেন, আরব আলীর ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। একজন মানুষ ৫২ বছর বয়সে আসামি হলেন, এখন তিনি ৯২ বছরের অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ। এই বয়সেও মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের চরম অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এ বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আর সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, আসামি কিংবা বাদী, উভয়ই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। এত বছর পরও মামলার বিচার শেষ না হওয়াটা চরম হতাশাজনক ব্যাপার।