যাত্রীরা পান না টিকিট, বাইরে বিক্রি করে দেন বুকিং সহকারী!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৬ পিএম, ২৩ মে,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩৭ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্রতিদিন সকাল ৮টায় ঢাকাগামী ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। তবে কয়েকটি বিক্রির পরই ঘোষণা দেয়া হয় টিকিট নেই। অথচ বুকিং কক্ষে বিভিন্নজনের ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য ব্যবহার করে টিকিট কেটে রাখা হয়। প্রতিদিন প্রকাশ্যে এ অনিয়ম চললেও দেখার যেন কেউ নেই। এ চিত্র বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে জংশনের টিকিট কাউন্টারের। ওই কাউন্টারের বুকিং সহকারী মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারিতে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
সান্তাহার রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে রেলওয়ের প্রাচীন ও বৃহত্তম জংশন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার স্টেশন। ত্রিমুখী রেলের সংযোগস্থল এবং পার্শ্ববর্তী নওগাঁ জেলার মোহনায় অবস্থিত স্টেশনটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন আন্তঃনগর, মেইল ও সাধারণ মিলিয়ে প্রায় ৩৬টি ট্রেন চলাচল করে। স্টেশন থেকে ঢাকার অভিমুখে যাত্রা করে পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেন। এ স্টেশন থেকে প্রতিদিন প্রথম শ্রেণির ছয়টি এসি সিট কেবিন, একটি এসি কেবিনের সিøপার, ২৫টি স্নিগ্ধা চেয়ার এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ১৮০টি শোভন চেয়ারসহ মোট ২১২টি আসনের টিকিট কাউন্টারে থেকে বিক্রি করা হয়।
৬ মে কাউন্টারে যা দেখা গেল : ৬ মে ভোরে নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলা এবং বগুড়ার আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া উপজেলা থেকে আসা শতাধিক যাত্রীরা ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কিনতে কাউন্টারে এসে ভিড় করেন। সকাল ৮টায় টিকিট কাউন্টার কক্ষে প্রবেশ করেন স্টেশন মাস্টার রেজাউল করিম ডালিম। কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা ঢাকামুখী আন্তঃনগর ট্রেনের প্রথম শ্রেণির অগ্রিম টিকিট চাইলে বুকিং সহকারী মতিউর রহমান এসি টিকিট নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন। স্টেশন মাস্টারের উপস্থিতিতে ওই মুহূর্তে প্রকাশ্যে তিনি একাধিক ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য ব্যবহার করে প্রথম শ্রেণির সব টিকিট এবং দ্বিতীয় শ্রেণির বেশকিছু টিকিট অবৈধভাবে কেটে কাউন্টারে সংরক্ষণ করেন। এ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির শোভন চেয়ারের টিকিট কেটে হতাশ হয়ে ফিরে যান। এর কিছু পরই টিকিট শেষ হয়েছে বলে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়।
৯ মে একই চিত্র : সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে লাইনের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তি দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকিট চাইলে তাকেও টিকিট নেই বলে জানিয়ে দেন মতিউর রহমান। অথচ মনিটরে ৮টা ১০ মিনিটেও প্রথম শ্রেণির স্নিগ্ধার দুটি আসন ফাঁকা আছে দেখা যায়। টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা শতাধিক যাত্রীরা অপেক্ষা করলেও কাউন্টারের ভেতরে বিভিন্নজনকে প্রবেশ করিয়ে একাধিক টিকিট কেটে দেন মতিউর রহমান। মোবাইলে এবং ক্যামেরায় এসব চিত্র ধারণ করার চেষ্টা করলে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেন তিনি।
যা বললেন যাত্রীরা : বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার দমদমা গ্রাম থেকে টিকিট কাউন্টারে এসে লাইনে দাঁড়ান গোলাম কিবরিয়া ও ছাতিয়ান গ্রাম থেকে আসা স্বাধীন হোসেন। তারা বলেন, ‘ঢাকার টিকিটের জন্য সকাল ৭টার মধ্যে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কাউন্টারে কিছুক্ষণ টিকিট বিক্রির পর যখন সিরিয়াল আসে তখন বলা হয় টিকিট শেষ। অথচ বুকিং সহকারী (মতিউর রহমান) প্রকাশ্যে কক্ষের ভেতরে বসে অতিরিক্ত টিকিট কেটে সংরক্ষণ করছিলেন।’
নওগাঁ সদর উপজেলার বরখোল গ্রাম থেকে আসা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণির দুটি টিকিট কাটতে ভোরে লাইনে দাঁড়াই। ২ নম্বর সিরিয়াল পাই। ৮টা বাজার পর চাইলে দ্রুতযানের প্রথম শ্রেণির কোনো টিকিট নেই বলে তারা সাফ জানিয়ে দেন। অথচ মনিটরে টিকিট শো করছিল। অনেক অনুরোধের পরও তারা টিকিট দেননি। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির দুইটি শোভন চেয়ার টিকিট কাটতে হয়।’ জেলার আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইসতিয়াক আহম্মেদ।
তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের চারটি টিকিটের জন্য সকাল ৭টার মধ্যে সান্তাহার টিকিট কাউন্টারে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পর যখন আমার সিরিয়াল আসে তখন তারা মাইকিং করেন টিকিট নেই। অথচ কক্ষের ভেতর থেকে টিকিট নিয়ে অনেকে বের হচ্ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘টিকিটগুলো কালোবাজারি করে দালালদের কাছে প্রতিনিয়ত বিক্রি করেন বুকিং সহকারী মতিউর রহমান। বাধ্য হয়ে দরদাম করে ৩৬০ টাকা দামের তিনটি টিকিট ২ হাজার ৭০০ টাকায় কিনতে হয়।’ জানতে চাইলে টিকিট কালোবাজারে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন বুকিং সহকারী মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘টিকিট থাকার পরও নেই এমনটা বলা হয়নি। অতিরিক্ত কোনো টিকিট কেটে কখনোই সংরক্ষণ করা হয় না। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তা এবং রেলওয়ের অফিস স্টাফদের প্রয়োজনীয় প্রথম শ্রেণির টিকিট কক্ষে বসেই আমি কেটে রাখি। তাদের অনুরোধ ফেলে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের সব সময় টিকিট দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে এর পরিমাণ খুবই সীমিত।’
সান্তাহার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের বুকিং অফিস ইনচার্জ মনিরুল করিম বলেন, নানাজনের অনুরোধ রাখতে গিয়ে ঈদসহ বিভিন্ন সময় প্রথম শ্রেণির অগ্রিম টিকিটগুলো অনেক সময় আমাদের কেটে রাখতে হয়। এখানে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাসহ সবাইকে সুবিধা দিয়ে চলতে হয়। তাই অনেক কিছুই নিয়মের ভেতরে করতে চাইলেও আমরা পারি না। কাউন্টারের ভেতরের কেউ টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে সান্তাহার জংশনের স্টেশন মাস্টার (গ্রেড-১) রেজাউল করিম ডালিম বলেন, ‘অনলাইনে টিকিট কেটে কেউ কালোবাজারে বিক্রি করলে সে দায়ভার তো বুকিং বিভাগের না। কাউন্টারের ভেতরে থেকে কেউ টিকিট কেটে সংরক্ষণ অথবা টিকিট থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ভিআইপি বিভিন্ন মাধ্যমে টিকিটের জন্য অনুরোধ করেন। গত ৬ মে প্রথম শ্রেণির কিছু টিকিট কাউন্টারের কক্ষের ভেতরে ঢুকে কাটতে হয়েছিল। তবে কোনো টিকিট কেটে সংরক্ষণ করা হয়নি। ওই মুহূর্তে দ্বিতীয় শ্রেণিরও কিছু টিকিট কাটা হয়ে থাকতে পারে।’
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে বিভাগীয় সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (উত্তর) নুরুল আলম বলেন, ‘ট্রেনের সিট ফাঁকা থাকলে টিকিট কেনার অধিকার সবারই আছে। এটা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য না।’ তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের টিকিট না দিয়ে হয়রানি করা বড় ধরনের অপরাধ। তবে বুকিং সহকারী টিকিট অবৈধভাবে বিক্রির সঙ্গে জড়িত আছে বলে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’