গণমাধ্যমকর্মী আইন প্রেস ফ্রিডমে চরম আঘাত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০৮ পিএম, ২১ মে,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩১ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যম আইন-২০২২’-এর মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থরক্ষার নামে গণমাধ্যম শিল্প ও এর কর্মীদের ওপর আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আনা হচ্ছে বলে মনে করেন সাংবাদিকরা। ইতিমধ্যে এ আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। বিদ্যমান শ্রম আইনকে যুগোপযোগী করে ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াকর্মীদের জন্য নতুন আইন করার দাবি জানিয়েছেন তারা। নেতারা বলছেন, সংশোধন না করে এই আইন পাস করাটা হবে প্রেস ফ্রিডমের প্রতি চরম আঘাত। কারণ এ আইনের ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টিই সাংবাদিকবান্ধব নয়।
সম্পাদক পরিষদের আপত্তি : সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়, গণমাধ্যম আদালত গঠনের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য আইনি জটিলতা সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে এ ধরনের আদালত স্বাধীনভাবে গণমাধ্যম পরিচালনাতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
পরিষদ আরও জানায়, এই আইন বাস্তবায়ন হলে এডিটোরিয়াল ইনস্টিটিউশন পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন খসড়াটি দিয়ে মালিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের পরস্পরের প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে এবং এতে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে সরকারকে সংবাদপত্র বন্ধের অধিকার দেয়া হয়েছে, যা এর আগের বিবর্তনমূলক আইন ‘স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’-এ ছিল। ওই আইন পরে বাতিল করা হয়েছিল।
পরিবর্তনে কাজ করছে সাত সংগঠন : এই আইনে নতুন করে যুক্ত করা বেশিরভাগ ধারা নিয়ে আপত্তি তুলে সাংবাদিকদের সাতটি সংগঠন একটি খসড়া প্রস্তুত করছে। আগামী সফতাহে তারা সেটি মন্ত্রণালয় ও স্থায়ী কমিটির কাছে হস্তান্তরের আশা করছেন। আইনটির সমালোচনা করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, ২০১৮ সালে এই আইনের যে খসড়া করা হয়েছিল তার সঙ্গে আমরা একমত ছিলাম। আমরা বলেছিলাম, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর করা আইনের সঙ্গে কেবল টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের যুক্ত করা হোক। পরে বাড়তি কিছু ধারা যুক্ত করা হলো। যার সঙ্গে আমরা একমত নই এবং আমাদের প্রাপ্য চলমান অধিকারগুলো সেখানে ক্ষুণœ হয়। তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া, বিনোদন ছুটি কমিয়ে দেয়া ও গণমাধ্যম আদালত গঠনের মতো ধারা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।
দীপ আজাদ বলেন, আমরা মনে করি শ্রম আদালতের মাধ্যমেই আমাদের অধিকার নিশ্চিত হয়। অন্য কোনও পেশার আলাদা আদালত নেই, আমাদের কেন লাগবে? ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত মনে করেন, নতুন এই আইনে মালিক ও কর্মীকে সরাসরি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের মালিক ও কর্মীদের মাঝে সম্পাদক/সম্পাদনা বিভাগের অস্তিত্ব বিলীন করে একটা ফাঁক তৈরি করা হয়েছে। এতে মালিক ও কর্মীকে মুখোমুখি অবস্থানে ফেলা হয়েছে। সেটা ক্ষতিকর হবে।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের ঐতিহ্যগত অধিকার এই আইনে খর্ব হয়েছে। খুব ভাবনা-চিন্তা করে প্রণীত হয়েছে মনে হয় না। সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও তার বিদ্যমান অর্থনৈতিক সুবিধা ছেঁটে ফেলে এমন পরিস্থিতি করা হয়েছে যা কোনোভাবেই অন্যান্য আইনের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়। এই আইন গণমাধ্যমের বিকাশ ব্যাহত করবে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় এটা সরাসরি হস্তক্ষেপ।
তিনি বলেন, সরকার যদিও বলছেন এটা আরও যাচাই বাছাই করা হবে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়। যদি সংশোধন না করা হয় তবে তা হবে প্রেস ফ্রিডমের প্রতি চরম আঘাত।
ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু আইনটির সমালোচনা করে বলেন, প্রস্তাবিত আইনটির খোলনলচে পাল্টাতে হবে।
তিনি বলেন, প্রথমত, গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, বরং এগুলো হরণ করা হয়েছে। শ্রম আইনে যে ন্যূনতম অধিকার ছিল সেটাও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যম মালিকদের অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাইয়ের একতরফা অধিকার দেয়া হয়েছে। এই ‘অতিরিক্ত’ শব্দের অতিরিক্ত সুযোগ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। আবার ছাঁটাইয়ের পর অফিসে পুলিশ ডেকে আনার সুযোগ রেখে সাংবাদিকদের অপমান করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ওয়েজবোর্ড গঠন বাধ্যতামূলক না করে মালিকদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ তহবিল গঠনের বিষয়টিও মালিকের ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের চাকরিজীবন শেষে সার্ভিস বেনিফিট অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। কল্যাণ সমিতি গঠনের নামে মালিকদের পোষ্য সংগঠন তৈরির বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে মালিক আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিলটি হুবহু পাস হলে দেশের কয়েক হাজার গণমাধ্যম মালিককে জেলে যেতে হবে। কারণ তারা আইনে বর্ণিত সময়সীমা এবং বিধি অনুযায়ী বেতন ভাতা দিতে পারবেন না।
চতুর্থত, সাংবাদিকদের অধিকার ক্ষুণœ করে এবং মালিক ও সাংবাদিকদের মধ্যকার সমস্যা নিরসনে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ রেখে কোনও আইন পাস হলে সেটা প্রকারান্তরে স্বাধীন সাংবাদিকতাকেই বাধাগ্রস্ত করবে এবং সংবাদপত্রের বিকাশ সংকুচিত করবে। খসড়া আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, সরাসরি না হলেও মোটা দাগে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে। এই আইন সাংবাদিকদের সেই অধিকার নিশ্চিত না করে বরং স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা তৈরি করবে। সেই অর্থে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা যেতে পারে। গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টারে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) ২৫ বছর পেরোনো সদস্য সংবাদপত্রগুলোকে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, গণমাধ্যমকর্মী আইনে কেবল প্রিন্ট মিডিয়া নয়, টেলিভিশনসহ সবাইকে যুক্ত করা হয়েছে। সবার কল্যাণেই এই আইন।