দুর্ভোগের নাম দৌলতদিয়া ঘাট, ঈদে বাড়বে কয়েক গুণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৪ পিএম, ১১ এপ্রিল,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩৪ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে দুর্ভোগ যেন নিত্যসঙ্গী। তবে ঈদে এ দুর্ভোগ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। মূলত ঘাট সংকট, ফেরি স্বল্পতা, নদীর নাব্যতা সংকটের সমাধান না হলে এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ঘরমুখো মানুষ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট ব্যবহার করে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে যান। কিন্তু যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, ফেরি সংকট ও নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে এক মাস ধরে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটের উভয় ঘাটেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি লেগে থাকছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোর মধ্যে যাত্রীবাহী বাসকে ফেরির নাগাল পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করতে হচ্ছে দিনের পর দিন।
দৌলতদিয়া ঘাট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পন্ডিমাঞ্চলের ২১ জেলার গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া। এ নৌরুটে গড়ে প্রতিদিন ছোট-বড় ১৮ থেকে ২০টি ফেরি দিয়ে চার থেকে পাঁচ হাজার যানবাহন পারাপার হয়ে থাকে। এছাড়া দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বর্তমানে ৩০টির মতো লঞ্চ চলাচল করে থাকে।যেখানে প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার যাত্রী নদী পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। ঈদকে ঘিরে এ রুটে যানবাহন ও যাত্রী কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, দৌলতদিয়া লঞ্চ ঘাটের অর্ধক অংশ পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের তান্ডবে লঞ্চে ওঠানামার একমাত্র কাঠের ব্রিজটিও বিকল হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে জরুরি ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে কোনো রকম লঞ্চঘাটটি সচল করে রাখে।
দৌলতদিয়ার কয়েকটি ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দৌলতদিয়ায় সাতটি ফেরিঘাট রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ঘাট সচল রয়েছে। ১ ও ২ নং ঘাট উদ্বোধনের পর থেকেই প্রায় পাঁচ বছর ধরে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবরে নদীভাঙনে দৌলতদিয়ার ১ ও ২ নম্বর ঘাট বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া গত বর্ষা মৌসুমের পর থেকে ৬ নং ফেরিঘাটও বিকল হয়ে পড়ে আছে। অবশিষ্ট ৩, ৪, ৫ ও ৭ নম্বর ঘাট সচল রয়েছে। বর্তমানে পদ্মা নদীর পানির গভীরতা নিচে নেমে যাওয়ায় ফেরি থেকে ভারী যানবাহন ওঠানামা করতে অনেক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সংযোগ সড়কে অনেক যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকে। এছাড়া নদীর কয়েকটি চ্যানেলে চর পড়ে যাওয়ায় উভয় ঘাটেই ফেরি ভিড়তে স্বাভাবিকের থেকেও দ্বিগুণ সময় লাগছে। এতে করে যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ভোগান্তির আরও একটি কারণ ফেরি স্বল্পতা। যানবাহন ও যাত্রী পারাপার নির্বিঘ্ন রাখতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ছোট-বড় মিলে ২৩টি ফেরি থাকলেও বর্তমানে ১৭টি ফেরি সচল রয়েছে। এসব ফেরিতে ২৪ ঘণ্টায় ৪-৫ হাজার গাড়ি পারাপার হয়। কিন্তু বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুট স্বাভাবিক না হওয়াতে এই রুটে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার গাড়ি বেড়েছে। ফলে যানবাহনের তুলনায় ফেরি সংখ্যা কম থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে।
ট্রাকচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঈদে যানবাহনের চাপ দ্বিগুণ হবে। এছাড়া ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢলও নামবে। তখন ১৬-১৭টি ফেরি দিয়ে এ চাপ সামলানো যাবে না। ঈদযাত্রায় চালক ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে ফেরি বাড়ানোর পাশাপাশি দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া লঞ্চঘাটের ম্যানেজার নুরুল আনোয়ার মিলন বলেন, গত বর্ষা মৌসুমে লঞ্চঘাটের কিছু অংশ ভেঙে যায়। ঘাট ভেঙে যাওয়ার পর থেকে যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। প্রতিনিয়ত এখান দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেকে নিচে পড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, লঞ্চঘাট থেকে বিআইডব্লিউটিএ প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করলেও কী কারণে তারা নীরব রয়েছে তা বুঝতে পারছি না। গত বর্ষা মৌসুমের পর থেকে টানা দুর্ভোগ শিকার করে যাত্রীরা চলাচল করছে। লঞ্চঘাটের সংযোগ সড়ক মেরামত না করলে এবার রোজার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষ ও ঈদ শেষে কর্মস্থলে যাত্রীদের কয়েকগুণ দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
ফেরি সমস্যা নিয়ে বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, ঢাকামুখী যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দৌলতদিয়ায় ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে যে পরিমাণ যানবাহন রয়েছে, তার জন্য আমাদের বহরে ফেরির সংখ্যা কম। কয়েকটি ফেরি মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ডে থাকায় এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তবে মেরামত শেষে ১৫-১৭ এপ্রিল দুটি রো রো (বড়) ফেরি আসার কথা রয়েছে। এছাড়া ঈদের আগে আরও তিন-চারটি বড় ফেরি বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ঈদযাত্রার চাপ সামাল দিতে মোট ২৩টি ফেরি চলাচল করবে। তখন আর ফেরি সংকট থাকবে না। আশা করছি ঈদে ঘরমুখো মানুষ ভোগান্তি ছাড়াই নদী পার হতে পারবে। পাটুরিয়া-আরিচা নদীবন্দরের পোর্ট অফিসার শাহ আলম বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথের দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে যাত্রীদের লঞ্চে ওঠানামা করতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঘাটটি দ্রুত মেরামত করার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত মেরামতের কাজ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আপাতত নতুন করে দৌলতদিয়ায় ফেরিঘাট তৈরির সুযোগ নেই। নদীর পানি বাড়লে বন্ধ থাকা ৬ নম্বর ঘাট হাইওয়াটার লেভেলে পন্টুন বসানো হলে ঘাট সংখ্যা বেড়ে যাবে। পদ্মা নদীর পানি বাড়লে অবশ্যই ঘাটগুলো মেরামত করা হবে। পানি নিচে চলে যাওয়ায় এভাবে কাজ করা যাবে না। পানি না বাড়া পর্যন্ত ঘাট এভাবেই থাকবে। যাত্রীদের সাময়িক দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করতে হবে। আবদুস সাত্তার, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (মেরিন), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয় রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এম এম শাকিলুজ্জামান বলেন, ঈদ যাত্রা নির্বিঘœ করতে যেকোনো ধরনের অপরাধ দমনে পুলিশ তৎপর থাকবে। এছাড়াও ঈদে ঘাট এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। তিনি আরও বলেন, ঘাটের মূল সমস্যা হচ্ছে ফেরি সংকট। ঈদের আগে ফেরি সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যাত্রী এবং যানবাহন স্বস্তিতেই নদী পার হতে পারবে।