৫ খাতে দুর্নীতির ৫৪ উৎস চিহ্নিত : দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৭ পিএম, ২১ মার্চ,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৩০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৯(১) ধারা অনুযায়ী প্রতি বছর রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করতে হয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)। কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাব ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় গত বছর প্রতিবেদন দাখিল করেনি সংস্থাটি। তাই রবিবার (২০ মার্চ) ২০২০ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন একত্রে পেশ করেছে দুদক। এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক সরকারের পাঁচটি খাতে দুর্নীতির উৎস ও তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা দিয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পেশ করা বার্ষিক প্রতিবেদনে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে ১০টি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ৬টি, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১০টি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য খাতে ১৩টি এবং প্রাণিসম্পদ খাতে দুর্নীতির ২৮টি উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর : ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মোট ১০ উৎস চিহ্নিত করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম। দুর্নীতির উৎসগুলো হলো-
ঔষধ প্রশাসন খাতে নতুন ফার্মাসিউটিক্যালস ইউনিট স্থাপন, ঔষধের কাঁচামাল এবং ঔষধ আমদানি ও প্রস্তুতকরণ, মোড়ক বা প্যাকেট প্রস্তুত ও ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন নিতে হয়। যেখানে ঔষধ প্রশাসন খাতে জড়িত অসৎ কর্মচারীরা খরচের বিভিন্ন প্যাকেজ অফার গ্রহণ করে সেবা গ্রহিতার থেকে। ঔষধ ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়ন ও মেয়াদোত্তীর্ণ বা নিম্নমানের ঔষধ বিক্রয়ে অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উপহার ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগসহ প্রভৃতির বিনিময়ে অসাধু ডাক্তারদেরকে প্রভাবিত করে নিম্নমানের অপ্রয়োজনীয় ঔষধ প্রেসক্রাইব করিয়ে নেয়। দেশে ঔষধ ক্রয় ও বিক্রয় পদ্ধতি সহজ বিধায় অনেক সময় ঔষধ বিক্রেতা নিজেই ডাক্তার সেজে রোগী দেখেন বা ক্রেতার কাছে নিম্নমানের ঔষধ বিক্রি করেন। হার্টের রিং বা স্ট্যান্ট, চোখের লেন্স/কন্ট্যাক্ট লেন্স, পেসমেকার ইত্যাদি জীবনরক্ষাকারী ও অত্যাবশ্যকীয় মেডিকেল ডিভাইস ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন সেবা গ্রহীতারা। নিম্নমানের ঔষধের লাইসেন্সপ্রাপ্তির বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখেন। ঔষধের কাঁচামাল আমদানি করে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তা কালোবাজারে বিক্রি হয়। ঔষধের জন্য একটি উৎস থেকে কাঁচামাল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
ফার্মাসিউটিক্যাল্স কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেয়ার পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যথাযথভাবে তাদের ঔষধের গুণগতমান যাচাই করা হয় না। স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকৃত বিভিন্ন ঔষধের গুণগতমান যথাযথ পরীক্ষা করা হয় না। এবং কোন কোম্পানি কোন ঔষধ তৈরি করছে, কোনটার স্ট্যান্ডার্ড কেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী হচ্ছে কি না- এসব বিষয় চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সক্ষমতার যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির অন্যতম উৎস বলেও এগুলো চিহ্নিত। এসব দুর্নীতির উৎস প্রতিরোধে দুদক ৫টি সুপারিশ করেছে বার্ষিক প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে দুর্নীতির ৬টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম। উৎসগুলো হলো- যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া এবং যানবাহন না দেখেই অবৈধ অর্থের বিনিময়ে যানবাহন রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয়। যেখানে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হয়ে থাকে। যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয়ার সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অবৈধ অর্থের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকারীদের পরীক্ষার তারিখ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিলম্বিত করা হয়, যাতে আবেদনকারীরা দালালের খপ্পরে পড়ে বা দালাল ধরতে বাধ্য হয়। একই কর্মচারীকে একাধিক ডেস্কে দায়িত্ব দিয়ে সেবা প্রদান কার্যক্রমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দালালদের অবৈধ দৌরাত্ম্যের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সকল তথ্য সংগ্রহের পরেও তা সরবরাহে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়। আবেদনকারীরা জরুরি প্রয়োজনে দালাল ধরতে বাধ্য হয়। যানবাহনের প্রকৃত মালিকের পরিচয় না জেনেই রেজিস্ট্রেশন সনদ প্রদান করা হয়। যেখানে কালো টাকার মালিকগণ বেনামিতে গাড়ি কেনার সুযোগ পাচ্ছে। আর বিআরটিএর এ সকল দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক তার বার্ষিক প্রতিবেদনে ৭টি সুপারিশ পেশ করেছে।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিস : দুদকের চোখে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। উৎসগুলো হলো- যে পরিমাণ দলিল রেজিস্ট্রি হয় তা বিদ্যমান নকলনবিশ দ্বারা প্রতিদিনের দলিল প্রতিদিনই কপি না হওয়ার কারণে মূল দলিল সরবরাহ করতে বিলম্ব হয় এবং সার্টিফায়েড কপি সরবরাহে ইচ্ছাকৃত জটিলতার সৃষ্টি করা হয়। যাতে সেবা পাওয়ার জন্য উৎকোচ দিতে বাধ্য হচ্ছেন সেবা গ্রহীতারা। দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় সরকারি রাজস্ব হিসাবে জমাকৃত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, চেক ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা হয় না। এতে এসব ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, চেকসমূহ সংশ্লিষ্ট দফতর হতে খোয়া যাচ্ছে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, চেক ইত্যাদি এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্টারের সকল কলাম পূরণ করা হয় না। দলিল রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর বিবরণসহ নোটিশ সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড অফিসে প্রেরণ করার কথা থাকলেও কৌশলে বিবরণ ছাড়াই তা প্রেরণ করা হয়। পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, চেক ইত্যাদি সময়মতো রাজস্ব খাতে জমা না হলে তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুকারী ব্যাংকে দাবিদারবিহীন পড়ে থাকে এবং একটি সময় ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা কর্তৃক তা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। দাতা-গ্রহীতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময়মূল্য বেশি হলেও তা দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের সহায়তায় কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কারণে প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন ফি থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। বিতর্কিত জমি রেজিস্ট্রেশন করে রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। কোনো দলিল রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়ে গেলে যদি সেটি জাল দলিল হিসেবে রেজিস্ট্রি হয় তবে দেওয়ানি আদালত ছাড়া ওই দলিল বাতিল করা জমির প্রকৃত মালিকের পক্ষে সম্ভব হয় না, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ সুযোগে প্রকৃত মালিক দীর্ঘমেয়াদি বিড়ম্বনায় পড়েন। নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্যের জনশ্রুতি রয়েছে। আইন ও ম্যানুয়াল অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বদলি, দলিল লেখক, নকলনবিশ নিয়োগের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারের। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়োগ ও বদলি আই.জি.আর-এর দপ্তর হতে করা হয়। নিয়োগ বহির্ভূত অনেক লোক রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে কাজ করেন, যাদের উমেদার বলে। অধিকাংশ অবৈধ লেনদেন এদের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
এরূপ দুর্নীতির উৎস বন্ধে ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ১০টি সুপারিশ করেছে বার্ষিক প্রতিবেদনে। এছাড়া বার্ষিক প্রতিবেদনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির ২৮টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম। যা প্রতিরোধে প্রায় একই পরিমাণ সুপারিশ করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম।