আমির হামজার স্বাধীনতা পদকে মনোনয়ন : তদন্ত করবে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০৪ পিএম, ১৬ মার্চ,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৫২ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাংলাদেশের চলতি বছরের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য সাহিত্য ক্যাটাগরিতে মনোনীত হওয়া আমির হামজার বিষয়ে তীব্র সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সরকার বলছে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে এবং যেসব বিষয় নিয়ে অনেকে আপত্তি করছে সেগুলো তদন্ত করা হবে। জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখবেন। তবে আমির হামজার মনোনয়ন বাতিল বা পর্যালোচনা করা হবে কি-না তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব তিনি দেননি। এর আগে ২০২০ সালে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর মনোনয়ন বাতিল করেছিল সরকার।
সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেছেন, আমির হামজাকে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কার না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বা পালাগান কিংবা অন্য কোনো অবদান থাকলে যাচাই সাপেক্ষে তার ভিত্তিতে দেয়া যেতো। আমি মনে করি পুরস্কার দেয়ার বর্তমান পদ্ধতিটাই বাতিল করা উচিত। এক-দুইজন আমলা বললো আর একজনকে মনোনয়ন দেয়া হলো-এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হকের মতো সাহিত্যিকরা এ পুরস্কার পেয়েছেন। সেই মর্যাদা বিবেচনায় নেয়া উচিত, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আনিসুল হক বলেছেন, আমির হামজার নাম তিনি আগে কখনো শোনেননি। বাংলাদেশের আরো কয়েকজন সুপরিচিত সাহিত্যিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় তার নাম দেখার পর অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন, কারণ আমির হামজার নাম সাহিত্য অঙ্গনে আগে শোনা যায়নি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মারা যাওয়া এ লেখকের দুটো বই আছে - ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ শিরোনামে।
কিভাবে এলো আমির হামজার নাম : আমির হামজা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং পালাগান কিংবা গীতিকবি হিসেবে নিজ এলাকায় তার পরিচিতিও আছে। তার ছেলে একজন সরকারি কর্মকর্তা। মূলত তিনিই আবেদন করেছিলেন তার বাবাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার জন্য। আর তাতে স্বাক্ষর করে সুপারিশ করেছিলেন একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। পরে মন্ত্রিসভা বিভাগ কর্তৃক গঠিত জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত কমিটি সেটি চূড়ান্ত করে নাম প্রকাশ করেছে। সে কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, কমিটিতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব আছেন। সবাই দেখেশুনেই নামগুলো চূড়ান্ত করেছে। ‘এখন আমি পত্রিকায় দেখেছি। তদন্ত করে আগে দেখি,’ বলছিলেন তিনি। কিন্তু এটি বাতিল বা পর্যালোচনার কোনো সম্ভাবনা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই এ বিষয়ে বলতে পারছি না, আগে দেখি বিষয়গুলো। এর আগে ২০২০ সালেও সাহিত্য ক্যাটাগরিতে যাকে প্রথমে মনোনয়ন দিয়েছিল তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। পরে সমালোচনার মুখে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের মনোনয়ন বাতিল করেছিল সরকার।
এবারেও পুরস্কার ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা দেখা যায়। সরকার সমর্থকদের কেউ কেউ অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা ও তৃণমূল পর্যায়ে পালাগান রচয়িতা হিসেবে আমির হামজাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। যদিও সরকার সমর্থকদেরই আরেকটি অংশ আমির হামজার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সরব হয়েছেন।
কীভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত হয় নাম : স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য সরকারের নির্ধারিত ছকে নাম প্রস্তাবের সুযোগ আছে। সেখানে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে তার অবদান জানাতে হয়। সেই আবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বা সচিব পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে চূড়ান্ত কমিটিতে যায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটি সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত করে থাকে।
সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, এ পদ্ধতির পরিবর্তে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি করা উচিত। ‘সংগীতজ্ঞরা ঠিক করবেন গানের ক্ষেত্রে কে পাবে, সাহিত্যিকরা ঠিক করবেন সাহিত্যে কে পাবে কিংবা প্রকৌশলীরা ঠিক করবেন কোনো প্রকৌশলী পেতে পারেন কি-না। পুরস্কারের জন্য আসা প্রস্তাবগুলো এভাবেই যাচাই-বাছাই করা উচিত,’ বলছিলেন তিনি।
সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু নাম : বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। সে বছর সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কারটি পেয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এর পরের বছর পল্লীকবি জসীম উদদীন ও তার পরের বছর পেয়েছেন আবুল মনসুর আহমেদ। এরপর থেকে গত বছর পর্যন্ত যারা সাহিত্য ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন কবি শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, কবি ফররুখ আহমদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মহাদেব সাহা, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হকের মতো সুপরিচিত লেখক-কবি ও সাহিত্যিকরা।
বাংলাদেশে জাতীয় পুরস্কার কতগুলো : মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০১৯ সালের ঘোষণা অনুযায়ী দেশে এখন ছয়টি জাতীয় পুরস্কার আছে। এগুলো হলো- স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে একটি পদক, পদকের রেপ্লিকা, নগদ টাকা ও সম্মাননাপত্র দেয়া হয়। এর মধ্যে স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এসবের পুরস্কারের বাইরেও জাতীয় পর্যায়ে দেয়া হয় জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা পুরস্কার, জাতীয় শিশু পুরস্কার, জাতীয় সমবায় পুরস্কার, জাতীয় যুব পুরস্কার ও রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার। যদিও এসব পুরস্কার জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আওতার বাইরে। মূলত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এসব পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকে।
সূত্র : বিবিসি