প্রবাসীকর্মীদের পেটের পীড়া : উদ্বেগ জানিয়ে আমিরাত ও কাতারের চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৯ পিএম, ৭ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:১৭ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
করোনা মহামারির বিধিনিষেধসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য প্রায় ৬ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে আসতে হয় প্রবাসীকর্মীদের। আর মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী যাত্রীদের আসতে হয় অন্তত ৮ ঘণ্টা আগে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে একটা লম্বা সময় প্রবাসীকর্মীদের কাটাতে হয় বিমানবন্দরেই। এ সময়ে তারা বিমানবন্দর ও আশপাশের দোকান ও ক্যান্টিন থেকে খাবার ও পানি কিনে যেমন খান, আবার অনেকেই খান বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার। অনেকে খরচ বাঁচাতে না খেয়েও থাকেন। দীর্ঘসময় অভুক্ত থাকা, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেওয়ায় অনেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যাদের অনেকেই কলেরাসহ নানা রকমের পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরইমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশিদের সেদেশে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
চিঠি পেয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট ১৬টি সংস্থার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়- বাংলাদেশি বিদেশযাত্রীদের মাঝে কলেরা ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হবে। বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে পানি ও খাবারের মান যাচাই করতে বিভিন্ন সংস্থা চালাবে অভিযান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে ১৮০ জন বাংলাদেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, বমি ও কলেরায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, কলেরা সাধারণ স্বাস্থ্যগত অসুস্থতা বিবেচনা করা হলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গুরুতর রোগ বিবেচনা করা হয়। যক্ষ্মা ও কলেরাকে ভয়ানক হিসেবেই বিবেচনা করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে। এ কারণে দেশ দুটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস সাংবাদিকদের বলেছেন, মূলত বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার পানি পান করার কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। তবে এ নিয়ে বেশি উদ্বেগের কিছু নেই।
গত বৃহস্পতিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, শত শত যাত্রী ফ্লাইটের ১০-১২ ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরে এসে বিভিন্ন স্থানে অপেক্ষা করছেন। কেউ বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে খোলা আকাশের নিচে, কেউ সামনের বাগানে বসে অপেক্ষা করছেন। বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিং ভবনের ২য় তলায় আরব আমিরাতগামী যাত্রীদের জন্য করোনা পরীক্ষার ল্যাব করা হয়েছে। সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে খাবারের দোকান, বসা ও টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আরব আমিরাতগামী যাত্রীদের ফ্লাইটের নির্ধারিত সময়ের আগের ৬ ঘণ্টা হিসাব করেই সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। কেউ ৬ ঘণ্টার আগে বিমানবন্দরে আসলে ল্যাব জোনে গিয়ে বসে বিশ্রাম করা, খাবার কিনে খাওয়া কিংবা সেখানের টয়লেট ব্যবহারের কোনও সুযোগ তারা পায় না। ফলে ওই ৬ ঘণ্টা সময়ের আগে আসা যাত্রীদের আশ্রয় নিতে হয় খোলা আকাশের নিচে বিমানবন্দরের পার্কিং কিংবা রাস্তায়। অন্যদিকে, বিমানবন্দরের মূল টার্মিনাল ভবনে প্রবেশের আগে যাত্রীরা নিজের সঙ্গে আনা খাবার ছাড়াও বিমানবন্দরের সামনের দোকান, পার্কিং ভবন, করোনা ল্যাব জোনে থাকা দোকান থেকে খাবার কিনে খান। তাছাড়া অনেকে এর আশপাশের রেস্তোরাঁ থেকেও খাবার কিনেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রবাসীকর্মীরা অতিরিক্ত তেল ও মশলাযুক্ত মাংস, বিরিয়ানি, তেহারি ও খিচুড়ি খান। পানি কিনে খাওয়া ও সহজলভ্য না হওয়ায় অনেকেই পর্যাপ্ত পানি পান করেন না।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা দুবাইগামী যাত্রী সোলাইমান হোসেন বলেন, রাত ১টায় ঢাকায় আসার গাড়িতে উঠেছি, সকাল ৭টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। আমার ফ্লাইট সন্ধ্যা ৬টায়। ৮ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে আসতে বলেছে। কিন্তু রাস্তায় যানজটসহ অন্য সমস্যার কথা চিন্তা করে আগেই রওনা দিতে হয়েছে।
অপেক্ষার এই সময়টাতে খাবারের কি ব্যবস্থা জানতে চাইলে সোলাইমান হোসেন বলেন, সকাল ৭টায় নেমে তো বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাবো, কোথায় বসবো, কি খাবো। আমার ফ্লাইট সন্ধ্যায় হওয়ায় আমাকে টার্মিনালের যেতে দেয়নি পুলিশ। সকালে পানি খেয়েছি। দুপুরে রাস্তার ওপার থেকে বিরিয়ানি কিনে খেলাম।
বহুতল কার পার্কিংয়ের উত্তর পাশে প্রস্রাবের উৎকট গন্ধের মধ্যে বসে আছেন কেউ কেউ। পার্কিং জোনের এখানে অনেকেই প্রস্রাব করেন। এখানে কেন প্রস্রাব করলেন জানতে চাইলে এক প্রবাসীকর্মী বলেন, কার পার্কিংয়ের নিচ তলায় পাবলিক টয়লেট আছে, তিনবার ৩০ টাকা দিয়ে সেই টয়লেট ব্যবহার করেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—যতবার নিচে নামি উপরে উঠতে গেলে আর্মড পুলিশ সদস্যরা আটকে দেয়। এতো ঝামেলাৃ উপরে একটা টয়লেট থাকলে ভালো হতো।
ঢাকা থেকে দূরবর্তী জেলার প্রবাসীদের বিমানবন্দরে আসতে ১০-১২ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। অনেকে বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার সঙ্গে নিয়ে আসেন। তবে দীর্ঘ সময়ে সেই খাবারের মান অক্ষুণœ থাকে না।
বাড়ি থেকে খিচুড়ি নিয়ে এসেছেন দুবাই প্রবাসী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে খিচুড়ি আনছিলাম। একটু গন্ধ হয়ে গেছে, তবু খাচ্ছি। আশেপাশে কই খাবার পাবো, কি খাবো, কতগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে।
তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নিম্নমানের কোনও খাবার বিমানবন্দরের ভেতরে বিক্রি হচ্ছে না। নিয়মিত তদারকি করা হয় বিমানবন্দরের খাবারের দোকানগুলোতে। বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিংয়ের দোতলায় করোনা পরীক্ষাগারের স্থানে যাত্রীদের সুবিধার জন্য চারটি খাবারের দোকান আছে, সেখানে খাবারও মানসম্মত।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, বিমানবন্দরের ভেতরে যেসব রেস্তোরাঁ আছে, সেগুলো আমরা নিয়মিত চেক করছি। স্যানিটারি ইনস্পেক্টরের আলাদা শাখা আছে এগুলো দেখভালের জন্য। পাশাপাশি করোনার পিসিআর পরীক্ষাগারে যে চারটি খাবারের দোকান আছে—সেগুলোও তদারকির মধ্যে আছে। এই সব রেস্তোরাঁতে কোনও পচা–বাসি খাবার খাওয়ানো হয় না। বিমানবন্দর এলাকায় খাবারের দাম একটু বেশি থাকায় অনেক সময় দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীরা নিজেরাই খাবার নিয়ে আসে। সেই খাবার আট ঘণ্টা পর বা একদিন পর ঠিক নাও থাকতে পারে। অথচ যাত্রীরা সেগুলো খাচ্ছেন। বিমানবন্দরের আশপাশের রেস্তোরাঁ, সড়কের পাশের দোকান ও রেলস্টেশনে যাত্রীরা বিভিন্ন খাবার খাচ্ছেন। এই খাবারগুলোর গুণগত মানের কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই বিমানবন্দরের ভেতরে বাইরের খাবার নিতে দেওয়া হচ্ছে না।
সুস্থ থাকার জন্য যাত্রীদের সচেতন হওয়া জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তৌহিদ-উল আহসান। তিনি বলেন, যাত্রীরা যেন কম দামে খারাপ খাবার না খান, এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার। বেশিক্ষণ না খেয়েও থাকা যাবে না। স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থেকে গুণগত মানসম্পন্ন খাবার খেতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকার খাবারের কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। বৃহস্পতিবার বিএসটিআই’য়ের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নাফিসা নাজ নীরার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকালে বিএসটিআই’র গুণগত মান সনদ (সিএম লাইসেন্স) গ্রহণ ব্যতীত বিক্রয়, বিতরণ, প্রদর্শন ও বাজারজাত করার অপরাধে এয়ারপোর্ট রেস্তোরাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। চকলেট, কেক, চিপস পণ্য সিএম সনদ ব্যতীত বিক্রয়ের অপরাধে বিমানবন্দরের টার্মিনালের এয়ারপোর্ট স্ন্যাকস-কে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, শীতল পাটি লাউঞ্জকে ১ লাখ টাকা, শর্মা হাউজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার পরিদর্শন করে বিভিন্ন বিষয়ে সর্তক করে পরামর্শ দেওয়া হয়। বিমানবন্দরের উল্টোপাশের হজ ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় পানির প্রায় ১০০ অবৈধ জার ধ্বংস করা হয়।